অনলাইন ডেস্ক
উফা আলী। ৬৭ বছর বয়সী এই ভারতীয় মুসলিমকে গত মে মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে পুশইন করা হয়। এরপর, দুঃসহ চার-চারটি দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে ৩১ মে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামে নিজ বাড়িতে ফেরেন। উফা আলী স্মরণ করেন, তিনি জন্ম থেকে দেখে আসছেন, বাংলাদেশ শব্দটি আসামে স্থানীয়দের কাছে ‘গালির মতো’।
উফার সপ্তাহব্যাপী দুর্ভোগের শুরু গত ২৩ মে। সেদিন আসামের মরিগাঁও জেলার কুইয়াদল নামের ছোট্ট গ্রামের ভাড়া বাড়ি থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আসামে ‘ঘোষিত বিদেশি নাগরিক’ বলে যে ক্যাটাগরি রয়েছে, তার আওতায় এই ধরপাকড় চালায় সরকার। আসাম ভারতের চা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার আদিবাসী—মূলত অহমিয়াদের সঙ্গে প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে আসা বাংলাভাষীদের বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এই বাংলাভাষীরা শত বছরের বেশি সময় আগে থেকে এই এলাকায় বসতি গড়েছেন।
২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রথমবার আসামের ক্ষমতায় আসার পর এই বিরোধ আরও বেড়ে গেছে। আসামে ভারতের যেকোনো রাজ্যের তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি। ৩ কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার রাজ্যটিতে মুসলমান মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাষ্য অনুযায়ী, গত মে থেকে উফা আলীর মতো ৩ শতাধিক মুসলমানকে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করা হয়েছে। শর্মা রাজ্য বিধানসভায় বলেন, ‘এই পুশইন আরও জোরদার করা হবে। রাজ্যকে বাঁচাতে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।’
গত ২৩ মে উফাকে আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় অবস্থিত ভারতের সবচেয়ে বড় ‘অবৈধ অভিবাসী’ আটক কেন্দ্রে। তিন দিন পর, ২৭ মে ভোরের দিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সদস্যরা পাঁচ নারী এবং উফা আলীসহ মোট ১৪ জনকে একটি ভ্যানে করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়।
আল-জাজিরাকে উফা আলী বলেন, ‘বিএসএফ আমাদের জোর করে ওপারে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি এবং স্থানীয়রা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা আমাদের নেবে না। কারণ, আমরা ভারতীয়।’ উভয় দেশের মাঝখানে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ খোলা মাঠে আটকে পড়েন তাঁরা। কোনো খাবার ও আশ্রয় ছাড়াই ১২ ঘণ্টা হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
উফা বলেন, ‘সেদিন নীল আকাশের নিচে আমরা নরক দেখেছি। চোখের সামনেই জীবন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছিল।’ তিনি জানান, ভারতের দিকে ফেরার চেষ্টা করলে বিএসএফ সদস্যরা হামলার হুমকি দেয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করছিলাম, যেন আমাদের বাংলাদেশের দিকে জোর করে পাঠানো না হয়। কিন্তু তারা আমাদের ওপর রাবার বুলেট ছোড়ে। ওই নো-ম্যানস ল্যান্ড আমাদের কাছে যেন কোনো দেশেরই অংশ ছিল না। মনে হচ্ছিল আমাদের জন্য কোনো দেশ নেই।’
একইভাবে আসামের পূর্বাঞ্চলীয় গোলাঘাট জেলা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগম বলেন, তিনিও ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডের’ বিভীষিকার স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে বিজিবি আমাকে হুমকি ধামকি দেয়। আমার সামনে কোনো রাস্তা ছিল না। বিএসএফ আমাকে হুমকি দেয়, যদি আমি ওপারে না যাই, তারা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।’
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের রৌমারীর সাংবাদিক যতেন চন্দ্র দাস আল-জাজিরাকে বলেন, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন বিএসএফ সদস্যরা ‘ভারতীয় নাগরিকদের’ লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়েছে। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে বিএসএফ সদস্যরা চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ২৭ মে এক বিবৃতিতে বিএসএফ এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা দাবি করে, শুধু অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করা লোকদের থামানোর চেষ্টা করেছে তারা।
অবশেষে, বাংলাদেশের স্থানীয় লোকজন এবং বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে উফা আলীকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এক সীমান্ত পয়েন্টে নিয়ে রেখে আসে বিজিবির সদস্যরা। সেখান থেকে তিনি ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বন-জঙ্গল ঘুরে নিজ বাড়িতে ফিরে যান।
গত ৩১ মে আসামের সংবাদপত্র ‘দ্য সেনটিনেল’ এক প্রতিবেদনে জানায়, বিজিবি ৬৫ ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশে পুশইন করা কয়েকজন মুসলমান আল-জাজিরাকে জানান, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন নিজেরাই ফিরে এসেছেন। যদিও এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশির ভাগ প্রত্যাবর্তনকারী জানান, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে ঢোকার পর ‘সাদা পোশাকের লোকেরা’ তাঁদের নিয়ে হাইওয়েতে ফেলে রেখে চলে যায়।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর দেশটিতে নতুন করে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বিতাড়নের অভিযান আরও জোরালো হয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘পেহেলগাম হামলাকে বিজেপি (যারা কেন্দ্র এবং আসাম রাজ্য দুই জায়গাতেই ক্ষমতায়) অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা রোহিঙ্গা এবং বাংলাভাষী মুসলিমদের মতো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের সুযোগ হিসেবে এই ঘটনাকে কাজে লাগাচ্ছে।’ অপূর্বানন্দ বলেন, ‘বিজেপি শাসিত ভারতে মুসলিম পরিচয়কে যেকোনোভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। সরকার বাংলাভাষী মুসলিমদের অবৈধ বাংলাদেশি বলেই ধরে নেয়।’
আসামের বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই বিতাড়নের পুরো প্রক্রিয়াই মূলত মুসলিমদের লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। আসাম কংগ্রেসের নেতা দেবব্রত শইকিয়া আল-জাজিরাকে বলেন, ‘মাটিয়া ডিটেনশন সেন্টার থেকে শুধু মুসলিমদেরই বেছে বেছে বের করে দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে বিজেপির মুখপাত্র মনোজ বরা দাবি করেন, এই পুরো প্রক্রিয়া ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। তিনি বলেন, ‘অবৈধ হিন্দুদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়নি। কারণ, তারা সেখানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন, যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।’
আসামে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন বহু দশকের পুরোনো, যার শিকড় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে প্রোথিত। উনিশ শতকে ব্রিটিশরা আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চা বাগান গড়ে তোলে। এতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের—যাদের মধ্যে মুসলিম ও হিন্দু দুই ধর্মের মানুষই ছিলেন—ব্যাপক হারে সেখানে নিয়ে আসা হয়। এদের বড় অংশ আসে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
বর্তমানে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে আসামের সঙ্গে ২৬০ কিলোমিটার। আসাম সরকার স্থির করেছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ—বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আগের দিন—এর আগে যারা আসামে এসেছেন, শুধু তাঁরাই ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
এ সংক্রান্ত নাগরিকত্বের মামলাগুলোর বিচার হয় আসামের বিশেষ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। এই ট্রাইব্যুনালগুলো একধরনের বিশেষ আদালত। খুব সামান্য বানান ভুল বা কাগজপত্রের অসংগতির ভিত্তিতে কাউকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে এসব আদালত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামের ট্রাইব্যুনালগুলো পক্ষপাতদুষ্ট এবং স্বেচ্ছাচারিতায় ভরা।
ওই বছরেই আসামে নাগরিক তালিকার (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়, যা ‘অবৈধ’ বাসিন্দাদের শনাক্ত করতে সরকারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল। চূড়ান্ত তালিকা থেকে প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়ে, যাদের মধ্যে ৭ লাখের বেশি মুসলিম। এই তালিকা প্রকাশের পর বহু মুসলিমকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয় এবং তাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
আলী নামের এক ব্যক্তির নাম এনআরসিতে থাকলেও ২০১৩ সালে মরিগাঁও জেলার একটি ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে। তাঁর বাবার নাম কখনও ‘সামত আলী’, কখনও ‘চামত আলী’ বা ‘চাহমত আলী’ হিসেবে সরকারি কাগজে উল্লেখ থাকায় তাঁকে নাগরিকত্ব হারাতে হয়। আলী দুই বছর ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। ২০১৪ সালে রাজ্যের হাইকোর্টও ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। আলী জানান, তিনি এতটাই দরিদ্র যে, সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সামর্থ্য নেই।
অনেক মুসলিম—যাদের বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে—বলছেন, তাঁদের নাগরিকত্বের মামলাগুলো এখনো আদালতে বিচারাধীন। তাই সরকার যেভাবে তাঁদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, তা বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারিতা। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্বীকার করেছেন, যাদের মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন, তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে কূটনৈতিক আলাপের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এরকমই একজন, বারপেতা জেলার বুড়িখামার গ্রামের বাসিন্দা ৫৯ বছর বয়সী সোনা বানু। গত ২৭ মে তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো কল্পনাও করিনি, যে দেশে আমি জন্মেছি, যেখানে আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদির জন্ম হয়েছে, সেই দেশই আমাকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠাবে। তারা আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল। অথচ জীবনে প্রথম এবং শেষবার বাংলাদেশ দেখেছি যখন সেটা মাত্র ১০ মিটার দূরে ছিল, নো-ম্যানস ল্যান্ডের ওপারে।’
মরিগাঁও জেলার মিকিরভিটা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম বলেন, তাঁকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো ছিল ‘মৃত্যুদণ্ডের মতো’। ২০১৬ সালে খাইরুল ইসলামকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হয়, যদিও তাঁর পরিবার ব্রিটিশ আমলের জমির দলিলসহ নানা প্রমাণপত্র আদালতে জমা দিয়েছিল। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা চালাচ্ছেন।
খাইরুল ইসলাম বলেন, নো-ম্যানস ল্যান্ডে কাটানো সময় তাঁর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শরণার্থীদের থেকেও খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। আমাদের কষ্ট-যন্ত্রণা যেন সবার সামনে উন্মুক্ত ছিল। আমরা ভারতের কাছে বিদেশি, বাংলাদেশের কাছেও বিদেশি।’
নিজাম আহমেদ (৫০) ভারতের সরকারি নথি অনুযায়ী বিদেশি নন। গোলাঘাটের জামুগুড়ি চা-বাগান এলাকার এই ট্রাকচালকের নাম রয়েছে আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকায়। তবুও তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে আসা হয়। নিজামের ছেলে জাহিদ জানান, বাবাকে আটকের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন, যখন বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাবাকে দেখা যাওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
জাহিদ বলেন, ‘আমরা ভারতীয়। আমার দাদু ছিলেন সেকেন্ড আসাম পুলিশ ব্যাটালিয়নে।’ আল-জাজিরা তাঁর এই দাবি নিশ্চিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজামের বাবা সেলিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৬০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আসাম রাজ্য পুলিশে চাকরি করেছেন। জাহিদ বলেন, ‘আমার দাদু বেঁচে থাকলে এটা তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হতো। একজন পুলিশ সদস্যের ছেলেকে বাংলাদেশ সীমান্তে ফেলে আসা হলো!’
সম্প্রতি ভারতে বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে কথিত ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়ার অভিযান আরও জোরদার হয়েছে। গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদের পুলিশ জানিয়েছে, তারা অন্তত ২৫০ জন ‘বাংলাদেশিকে’ চিহ্নিত করেছে, যারা নাকি অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছিলেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে পুলিশ কর্মকর্তা অজিত রাজিয়ান বলেছেন, ‘তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’
ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রেও গত মাসে ৭ মুসলিমকে ‘বিদেশি’ সন্দেহে আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা হয়। তবে ১৫ জুন ওই সাতজনকে আবার সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। কারণ তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বলে জানায় রাজ্য সরকার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের (এআইটিসি) বিধায়ক এবং পশ্চিমবঙ্গ মাইগ্র্যান্ট ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম।
সামিরুল ইসলাম বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসন মহারাষ্ট্র পুলিশকে জানিয়েছিল, এরা সবাই পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে তাদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’ এ বিষয়ে ১৬ জুন কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘শুধু বাংলা বলার কারণে তাদের বাংলাদেশি বলা হলো এবং বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’
আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলা ওই সাতজনের মধ্যে তিনজন জানান, তাঁরা মহারাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তাদের পরিবার এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ভারতীয় নাগরিকত্বের যাবতীয় প্রমাণাদি জমা দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা মিরানুল শেখ এবং নিজামউদ্দিন শেখকেও সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে দেখা গেছে। এর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
৩২ বছর বয়সী মিরানুল শেখ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি আমরা মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা, কিন্তু বিএসএফ আমাদের মারধর করেছে। আমাদের বলা হয়েছে, ফিরলে গুলি করব।’ এ বিষয়ে আল-জাজিরা ১৯ জুন বিএসএফকে ই-মেইল করে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলেও তারা এখনো সাড়া দেয়নি।
আসামে পুলিশের অভিযানে গত ২৫ মে গোলাঘাট জেলার নওজান গ্রাম থেকে আব্দুল হানিফ নামের এক বাংলাভাষী মুসলিমকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। কোনো কারণও দেখায়নি পুলিশ। হানিফের বড় ভাই দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ বলেছিল, দুদিন পর ছেড়ে দেবে।’
আসামের চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ ও বিদ্বেষ রয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, এটি ছিল ‘রুটিন ভেরিফিকেশন’। কিন্তু এরপর থেকেই হানিফকে মরিয়া হয়ে খোঁজে তাঁর পরিবার। দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘আমরা এক থানার পর আরেক থানায় গিয়েছি, খুঁজেছি। কিন্তু পুলিশ কিছু বলছে না।’
দ্বীন দাবি করেন, হানিফকে শেষবার গোলাঘাটের পুলিশ সুপার রাজেন সিংহের অফিসে দেখা যায়। পরে যাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো হয়, তাদের সঙ্গেই ছিলেন হানিফ। তাঁর ভাষ্য, ‘হানিফ কোনোভাবেই বিদেশি নন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ট্রাইব্যুনালে মামলা নেই। শুধু “মিঞা” বলে সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘মিঞা’ শব্দটি আসামের আদিবাসী অহমিয়াদের মধ্যে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘অবজ্ঞা সূচকভাবে বাংলাদেশি’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। হানিফের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার রাজেন সিংহ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না।’
এক স্থানীয় বাসিন্দাকেও হানিফের সঙ্গে পুলিশ সুপারের অফিসে নেওয়া হয় এবং পরে তাঁকেও সীমান্তে নেওয়া হয়। তিনি জানান, তাঁদের দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সম্ভবত হানিফকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘রাতারাতি লোকজন উধাও হয়ে যাচ্ছে। হানিফও হয়তো অনেকের মতো বাংলাদেশে হারিয়ে গেছে।’
আল-জাজিরা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করেছে, গত মাসে যাদের নো-ম্যানস ল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের এখনো কোনো খোঁজ নেই। আসামে নিখোঁজ হওয়া সদস্যদের সন্ধান দাবিতে অন্তত চারটি পরিবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। আসাম হাইকোর্টে তাঁরা পিটিশন দায়ের করেছেন। নিখোঁজদের মধ্যে অন্তত দুটি পরিবার রাজ্য সরকারের স্বীকৃত ‘দেশি’ মুসলিম সম্প্রদায়ের। এই সম্প্রদায়কে আসামের আদিবাসী মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিখোঁজ সামসুল আলীর ছেলে বক্কর আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, আমরা আদিবাসী মুসলিম, তাই নিরাপদ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এখানে কোনো মুসলিম-ই নিরাপদ নয়।’ বক্কর আলীর দাবি, তাঁর বাবা এখন বাংলাদেশে পুলিশের হেফাজতে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার জেল সুপার আমিরুল ইসলাম আল-জাজিরাকে ১৬ জুন জানিয়েছেন, আরেক দেশি (ভারতীয়) মুসলিম, দইজান বিবিও বাংলাদেশ পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মুখপাত্র ফয়সাল মাহমুদ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে ভারতকে জানিয়েছে যে, বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে মানুষকে ঠেলে পাঠাচ্ছে, তা কোনো আইনি প্রক্রিয়া মেনে করা হচ্ছে না।’ এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও আল-জাজিরা কোনো সাড়া পায়নি।
উত্তর-পূর্ব ভারত বিশ্লেষক এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও লন্ডনের কিংস কলেজ লন্ডনের যৌথ গবেষণা সহকারী অংশুমান চৌধুরী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আসামের সরকার যেটাকে পুশব্যাক বলছে, সেটা আদতে জোরপূর্বক বহিষ্কার।’ তিনি বলেন, ‘পুশব্যাকের মানে হলো, কোনো অভিবাসী অবৈধভাবে সীমান্তে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকার নিজেই লোকজনকে ধরে নিয়ে আরেক দেশে ফেলে দিচ্ছে।’
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকারের এই পদক্ষেপের জন্য ১৯৫০ সালের এক আইন দেখাচ্ছেন। ওই আইনে জেলা প্রশাসকদের নির্দিষ্ট কিছু অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসামের হাইকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ওয়ালিউল্লাহ লস্কর বলেন, ‘এই আইন শুধু তাদের জন্য, যারা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছে বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থাকছে। এটা কোনোভাবেই তাদের জন্য নয়, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করছে এবং যাদের হাতে রাজ্য সরকারের দেওয়া নাগরিকত্বের নথি আছে।’
আরেক স্থানীয় আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘোষিত বিদেশি’ বন্দীদের বিষয়ে শুনানির সময় আসাম সরকার নিজেই বলেছে, যাদের বাংলাদেশে কোনো ঠিকানা জানা নেই, তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। সরকার হলফনামায় উল্লেখ করেছে, ‘বিদেশি দেশটির পক্ষ থেকে জাতীয়তা যাচাই এবং ভ্রমণের অনুমতি না পেলে, এই বন্দীদের ফেরত পাঠানো যাবে না।’
গত বছর আসাম সরকার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে রাজ্যে আসা অমুসলিম, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ট্রাইব্যুনালে না পাঠানোর জন্য। ভারতের বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে যাঁরা ওই সময়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে শুধু অমুসলিমদের জন্যই এই সুবিধা। এই আইন ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার লঙ্ঘন বলে দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়েছিল। জাতিসংঘ এই আইনকে ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
ক্ষুব্ধ বক্কর আলী বলেন, ‘আমাদের জাতীয়তা প্রমাণ করতে ২০-৩০টা কাগজ দেখাতে হয়। অথচ বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের শুধু বলতে হয় যে তারা হিন্দু, তাহলেই নাগরিকত্ব হয়ে যায়।’ গোলাঘাটে নিজের বাড়ির সামনে বসে থাকা ৫০ বছর বয়সী বেগম বলেন, বিএসএফ তাঁকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জন্মভূমির এমন আচরণে তিনি ভীষণ হতাশ। তিনি বলেন, ‘এই দেশ আমার, কিন্তু আমি এই দেশের না।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
উফা আলী। ৬৭ বছর বয়সী এই ভারতীয় মুসলিমকে গত মে মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে পুশইন করা হয়। এরপর, দুঃসহ চার-চারটি দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে ৩১ মে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামে নিজ বাড়িতে ফেরেন। উফা আলী স্মরণ করেন, তিনি জন্ম থেকে দেখে আসছেন, বাংলাদেশ শব্দটি আসামে স্থানীয়দের কাছে ‘গালির মতো’।
উফার সপ্তাহব্যাপী দুর্ভোগের শুরু গত ২৩ মে। সেদিন আসামের মরিগাঁও জেলার কুইয়াদল নামের ছোট্ট গ্রামের ভাড়া বাড়ি থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আসামে ‘ঘোষিত বিদেশি নাগরিক’ বলে যে ক্যাটাগরি রয়েছে, তার আওতায় এই ধরপাকড় চালায় সরকার। আসাম ভারতের চা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার আদিবাসী—মূলত অহমিয়াদের সঙ্গে প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে আসা বাংলাভাষীদের বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এই বাংলাভাষীরা শত বছরের বেশি সময় আগে থেকে এই এলাকায় বসতি গড়েছেন।
২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রথমবার আসামের ক্ষমতায় আসার পর এই বিরোধ আরও বেড়ে গেছে। আসামে ভারতের যেকোনো রাজ্যের তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি। ৩ কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার রাজ্যটিতে মুসলমান মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাষ্য অনুযায়ী, গত মে থেকে উফা আলীর মতো ৩ শতাধিক মুসলমানকে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করা হয়েছে। শর্মা রাজ্য বিধানসভায় বলেন, ‘এই পুশইন আরও জোরদার করা হবে। রাজ্যকে বাঁচাতে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।’
গত ২৩ মে উফাকে আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় অবস্থিত ভারতের সবচেয়ে বড় ‘অবৈধ অভিবাসী’ আটক কেন্দ্রে। তিন দিন পর, ২৭ মে ভোরের দিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সদস্যরা পাঁচ নারী এবং উফা আলীসহ মোট ১৪ জনকে একটি ভ্যানে করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়।
আল-জাজিরাকে উফা আলী বলেন, ‘বিএসএফ আমাদের জোর করে ওপারে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি এবং স্থানীয়রা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা আমাদের নেবে না। কারণ, আমরা ভারতীয়।’ উভয় দেশের মাঝখানে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ খোলা মাঠে আটকে পড়েন তাঁরা। কোনো খাবার ও আশ্রয় ছাড়াই ১২ ঘণ্টা হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
উফা বলেন, ‘সেদিন নীল আকাশের নিচে আমরা নরক দেখেছি। চোখের সামনেই জীবন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছিল।’ তিনি জানান, ভারতের দিকে ফেরার চেষ্টা করলে বিএসএফ সদস্যরা হামলার হুমকি দেয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করছিলাম, যেন আমাদের বাংলাদেশের দিকে জোর করে পাঠানো না হয়। কিন্তু তারা আমাদের ওপর রাবার বুলেট ছোড়ে। ওই নো-ম্যানস ল্যান্ড আমাদের কাছে যেন কোনো দেশেরই অংশ ছিল না। মনে হচ্ছিল আমাদের জন্য কোনো দেশ নেই।’
একইভাবে আসামের পূর্বাঞ্চলীয় গোলাঘাট জেলা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগম বলেন, তিনিও ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডের’ বিভীষিকার স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে বিজিবি আমাকে হুমকি ধামকি দেয়। আমার সামনে কোনো রাস্তা ছিল না। বিএসএফ আমাকে হুমকি দেয়, যদি আমি ওপারে না যাই, তারা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।’
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের রৌমারীর সাংবাদিক যতেন চন্দ্র দাস আল-জাজিরাকে বলেন, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন বিএসএফ সদস্যরা ‘ভারতীয় নাগরিকদের’ লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়েছে। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে বিএসএফ সদস্যরা চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ২৭ মে এক বিবৃতিতে বিএসএফ এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা দাবি করে, শুধু অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করা লোকদের থামানোর চেষ্টা করেছে তারা।
অবশেষে, বাংলাদেশের স্থানীয় লোকজন এবং বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে উফা আলীকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এক সীমান্ত পয়েন্টে নিয়ে রেখে আসে বিজিবির সদস্যরা। সেখান থেকে তিনি ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বন-জঙ্গল ঘুরে নিজ বাড়িতে ফিরে যান।
গত ৩১ মে আসামের সংবাদপত্র ‘দ্য সেনটিনেল’ এক প্রতিবেদনে জানায়, বিজিবি ৬৫ ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশে পুশইন করা কয়েকজন মুসলমান আল-জাজিরাকে জানান, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন নিজেরাই ফিরে এসেছেন। যদিও এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশির ভাগ প্রত্যাবর্তনকারী জানান, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে ঢোকার পর ‘সাদা পোশাকের লোকেরা’ তাঁদের নিয়ে হাইওয়েতে ফেলে রেখে চলে যায়।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর দেশটিতে নতুন করে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বিতাড়নের অভিযান আরও জোরালো হয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘পেহেলগাম হামলাকে বিজেপি (যারা কেন্দ্র এবং আসাম রাজ্য দুই জায়গাতেই ক্ষমতায়) অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা রোহিঙ্গা এবং বাংলাভাষী মুসলিমদের মতো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের সুযোগ হিসেবে এই ঘটনাকে কাজে লাগাচ্ছে।’ অপূর্বানন্দ বলেন, ‘বিজেপি শাসিত ভারতে মুসলিম পরিচয়কে যেকোনোভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। সরকার বাংলাভাষী মুসলিমদের অবৈধ বাংলাদেশি বলেই ধরে নেয়।’
আসামের বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই বিতাড়নের পুরো প্রক্রিয়াই মূলত মুসলিমদের লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। আসাম কংগ্রেসের নেতা দেবব্রত শইকিয়া আল-জাজিরাকে বলেন, ‘মাটিয়া ডিটেনশন সেন্টার থেকে শুধু মুসলিমদেরই বেছে বেছে বের করে দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে বিজেপির মুখপাত্র মনোজ বরা দাবি করেন, এই পুরো প্রক্রিয়া ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। তিনি বলেন, ‘অবৈধ হিন্দুদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়নি। কারণ, তারা সেখানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন, যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।’
আসামে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন বহু দশকের পুরোনো, যার শিকড় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে প্রোথিত। উনিশ শতকে ব্রিটিশরা আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চা বাগান গড়ে তোলে। এতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের—যাদের মধ্যে মুসলিম ও হিন্দু দুই ধর্মের মানুষই ছিলেন—ব্যাপক হারে সেখানে নিয়ে আসা হয়। এদের বড় অংশ আসে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
বর্তমানে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে আসামের সঙ্গে ২৬০ কিলোমিটার। আসাম সরকার স্থির করেছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ—বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আগের দিন—এর আগে যারা আসামে এসেছেন, শুধু তাঁরাই ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
এ সংক্রান্ত নাগরিকত্বের মামলাগুলোর বিচার হয় আসামের বিশেষ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। এই ট্রাইব্যুনালগুলো একধরনের বিশেষ আদালত। খুব সামান্য বানান ভুল বা কাগজপত্রের অসংগতির ভিত্তিতে কাউকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে এসব আদালত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামের ট্রাইব্যুনালগুলো পক্ষপাতদুষ্ট এবং স্বেচ্ছাচারিতায় ভরা।
ওই বছরেই আসামে নাগরিক তালিকার (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়, যা ‘অবৈধ’ বাসিন্দাদের শনাক্ত করতে সরকারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল। চূড়ান্ত তালিকা থেকে প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়ে, যাদের মধ্যে ৭ লাখের বেশি মুসলিম। এই তালিকা প্রকাশের পর বহু মুসলিমকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয় এবং তাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
আলী নামের এক ব্যক্তির নাম এনআরসিতে থাকলেও ২০১৩ সালে মরিগাঁও জেলার একটি ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে। তাঁর বাবার নাম কখনও ‘সামত আলী’, কখনও ‘চামত আলী’ বা ‘চাহমত আলী’ হিসেবে সরকারি কাগজে উল্লেখ থাকায় তাঁকে নাগরিকত্ব হারাতে হয়। আলী দুই বছর ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। ২০১৪ সালে রাজ্যের হাইকোর্টও ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। আলী জানান, তিনি এতটাই দরিদ্র যে, সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সামর্থ্য নেই।
অনেক মুসলিম—যাদের বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে—বলছেন, তাঁদের নাগরিকত্বের মামলাগুলো এখনো আদালতে বিচারাধীন। তাই সরকার যেভাবে তাঁদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, তা বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারিতা। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্বীকার করেছেন, যাদের মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন, তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে কূটনৈতিক আলাপের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এরকমই একজন, বারপেতা জেলার বুড়িখামার গ্রামের বাসিন্দা ৫৯ বছর বয়সী সোনা বানু। গত ২৭ মে তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো কল্পনাও করিনি, যে দেশে আমি জন্মেছি, যেখানে আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদির জন্ম হয়েছে, সেই দেশই আমাকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠাবে। তারা আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল। অথচ জীবনে প্রথম এবং শেষবার বাংলাদেশ দেখেছি যখন সেটা মাত্র ১০ মিটার দূরে ছিল, নো-ম্যানস ল্যান্ডের ওপারে।’
মরিগাঁও জেলার মিকিরভিটা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম বলেন, তাঁকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো ছিল ‘মৃত্যুদণ্ডের মতো’। ২০১৬ সালে খাইরুল ইসলামকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হয়, যদিও তাঁর পরিবার ব্রিটিশ আমলের জমির দলিলসহ নানা প্রমাণপত্র আদালতে জমা দিয়েছিল। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা চালাচ্ছেন।
খাইরুল ইসলাম বলেন, নো-ম্যানস ল্যান্ডে কাটানো সময় তাঁর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শরণার্থীদের থেকেও খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। আমাদের কষ্ট-যন্ত্রণা যেন সবার সামনে উন্মুক্ত ছিল। আমরা ভারতের কাছে বিদেশি, বাংলাদেশের কাছেও বিদেশি।’
নিজাম আহমেদ (৫০) ভারতের সরকারি নথি অনুযায়ী বিদেশি নন। গোলাঘাটের জামুগুড়ি চা-বাগান এলাকার এই ট্রাকচালকের নাম রয়েছে আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকায়। তবুও তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে আসা হয়। নিজামের ছেলে জাহিদ জানান, বাবাকে আটকের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন, যখন বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাবাকে দেখা যাওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
জাহিদ বলেন, ‘আমরা ভারতীয়। আমার দাদু ছিলেন সেকেন্ড আসাম পুলিশ ব্যাটালিয়নে।’ আল-জাজিরা তাঁর এই দাবি নিশ্চিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজামের বাবা সেলিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৬০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আসাম রাজ্য পুলিশে চাকরি করেছেন। জাহিদ বলেন, ‘আমার দাদু বেঁচে থাকলে এটা তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হতো। একজন পুলিশ সদস্যের ছেলেকে বাংলাদেশ সীমান্তে ফেলে আসা হলো!’
সম্প্রতি ভারতে বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে কথিত ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়ার অভিযান আরও জোরদার হয়েছে। গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদের পুলিশ জানিয়েছে, তারা অন্তত ২৫০ জন ‘বাংলাদেশিকে’ চিহ্নিত করেছে, যারা নাকি অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছিলেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে পুলিশ কর্মকর্তা অজিত রাজিয়ান বলেছেন, ‘তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’
ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রেও গত মাসে ৭ মুসলিমকে ‘বিদেশি’ সন্দেহে আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা হয়। তবে ১৫ জুন ওই সাতজনকে আবার সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। কারণ তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বলে জানায় রাজ্য সরকার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের (এআইটিসি) বিধায়ক এবং পশ্চিমবঙ্গ মাইগ্র্যান্ট ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম।
সামিরুল ইসলাম বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসন মহারাষ্ট্র পুলিশকে জানিয়েছিল, এরা সবাই পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে তাদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’ এ বিষয়ে ১৬ জুন কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘শুধু বাংলা বলার কারণে তাদের বাংলাদেশি বলা হলো এবং বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’
আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলা ওই সাতজনের মধ্যে তিনজন জানান, তাঁরা মহারাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তাদের পরিবার এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ভারতীয় নাগরিকত্বের যাবতীয় প্রমাণাদি জমা দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা মিরানুল শেখ এবং নিজামউদ্দিন শেখকেও সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে দেখা গেছে। এর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
৩২ বছর বয়সী মিরানুল শেখ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি আমরা মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা, কিন্তু বিএসএফ আমাদের মারধর করেছে। আমাদের বলা হয়েছে, ফিরলে গুলি করব।’ এ বিষয়ে আল-জাজিরা ১৯ জুন বিএসএফকে ই-মেইল করে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলেও তারা এখনো সাড়া দেয়নি।
আসামে পুলিশের অভিযানে গত ২৫ মে গোলাঘাট জেলার নওজান গ্রাম থেকে আব্দুল হানিফ নামের এক বাংলাভাষী মুসলিমকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। কোনো কারণও দেখায়নি পুলিশ। হানিফের বড় ভাই দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ বলেছিল, দুদিন পর ছেড়ে দেবে।’
আসামের চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ ও বিদ্বেষ রয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, এটি ছিল ‘রুটিন ভেরিফিকেশন’। কিন্তু এরপর থেকেই হানিফকে মরিয়া হয়ে খোঁজে তাঁর পরিবার। দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘আমরা এক থানার পর আরেক থানায় গিয়েছি, খুঁজেছি। কিন্তু পুলিশ কিছু বলছে না।’
দ্বীন দাবি করেন, হানিফকে শেষবার গোলাঘাটের পুলিশ সুপার রাজেন সিংহের অফিসে দেখা যায়। পরে যাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো হয়, তাদের সঙ্গেই ছিলেন হানিফ। তাঁর ভাষ্য, ‘হানিফ কোনোভাবেই বিদেশি নন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ট্রাইব্যুনালে মামলা নেই। শুধু “মিঞা” বলে সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘মিঞা’ শব্দটি আসামের আদিবাসী অহমিয়াদের মধ্যে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘অবজ্ঞা সূচকভাবে বাংলাদেশি’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। হানিফের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার রাজেন সিংহ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না।’
এক স্থানীয় বাসিন্দাকেও হানিফের সঙ্গে পুলিশ সুপারের অফিসে নেওয়া হয় এবং পরে তাঁকেও সীমান্তে নেওয়া হয়। তিনি জানান, তাঁদের দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সম্ভবত হানিফকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘রাতারাতি লোকজন উধাও হয়ে যাচ্ছে। হানিফও হয়তো অনেকের মতো বাংলাদেশে হারিয়ে গেছে।’
আল-জাজিরা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করেছে, গত মাসে যাদের নো-ম্যানস ল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের এখনো কোনো খোঁজ নেই। আসামে নিখোঁজ হওয়া সদস্যদের সন্ধান দাবিতে অন্তত চারটি পরিবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। আসাম হাইকোর্টে তাঁরা পিটিশন দায়ের করেছেন। নিখোঁজদের মধ্যে অন্তত দুটি পরিবার রাজ্য সরকারের স্বীকৃত ‘দেশি’ মুসলিম সম্প্রদায়ের। এই সম্প্রদায়কে আসামের আদিবাসী মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিখোঁজ সামসুল আলীর ছেলে বক্কর আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, আমরা আদিবাসী মুসলিম, তাই নিরাপদ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এখানে কোনো মুসলিম-ই নিরাপদ নয়।’ বক্কর আলীর দাবি, তাঁর বাবা এখন বাংলাদেশে পুলিশের হেফাজতে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার জেল সুপার আমিরুল ইসলাম আল-জাজিরাকে ১৬ জুন জানিয়েছেন, আরেক দেশি (ভারতীয়) মুসলিম, দইজান বিবিও বাংলাদেশ পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মুখপাত্র ফয়সাল মাহমুদ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে ভারতকে জানিয়েছে যে, বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে মানুষকে ঠেলে পাঠাচ্ছে, তা কোনো আইনি প্রক্রিয়া মেনে করা হচ্ছে না।’ এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও আল-জাজিরা কোনো সাড়া পায়নি।
উত্তর-পূর্ব ভারত বিশ্লেষক এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও লন্ডনের কিংস কলেজ লন্ডনের যৌথ গবেষণা সহকারী অংশুমান চৌধুরী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আসামের সরকার যেটাকে পুশব্যাক বলছে, সেটা আদতে জোরপূর্বক বহিষ্কার।’ তিনি বলেন, ‘পুশব্যাকের মানে হলো, কোনো অভিবাসী অবৈধভাবে সীমান্তে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকার নিজেই লোকজনকে ধরে নিয়ে আরেক দেশে ফেলে দিচ্ছে।’
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকারের এই পদক্ষেপের জন্য ১৯৫০ সালের এক আইন দেখাচ্ছেন। ওই আইনে জেলা প্রশাসকদের নির্দিষ্ট কিছু অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসামের হাইকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ওয়ালিউল্লাহ লস্কর বলেন, ‘এই আইন শুধু তাদের জন্য, যারা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছে বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থাকছে। এটা কোনোভাবেই তাদের জন্য নয়, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করছে এবং যাদের হাতে রাজ্য সরকারের দেওয়া নাগরিকত্বের নথি আছে।’
আরেক স্থানীয় আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘোষিত বিদেশি’ বন্দীদের বিষয়ে শুনানির সময় আসাম সরকার নিজেই বলেছে, যাদের বাংলাদেশে কোনো ঠিকানা জানা নেই, তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। সরকার হলফনামায় উল্লেখ করেছে, ‘বিদেশি দেশটির পক্ষ থেকে জাতীয়তা যাচাই এবং ভ্রমণের অনুমতি না পেলে, এই বন্দীদের ফেরত পাঠানো যাবে না।’
গত বছর আসাম সরকার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে রাজ্যে আসা অমুসলিম, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ট্রাইব্যুনালে না পাঠানোর জন্য। ভারতের বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে যাঁরা ওই সময়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে শুধু অমুসলিমদের জন্যই এই সুবিধা। এই আইন ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার লঙ্ঘন বলে দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়েছিল। জাতিসংঘ এই আইনকে ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
ক্ষুব্ধ বক্কর আলী বলেন, ‘আমাদের জাতীয়তা প্রমাণ করতে ২০-৩০টা কাগজ দেখাতে হয়। অথচ বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের শুধু বলতে হয় যে তারা হিন্দু, তাহলেই নাগরিকত্ব হয়ে যায়।’ গোলাঘাটে নিজের বাড়ির সামনে বসে থাকা ৫০ বছর বয়সী বেগম বলেন, বিএসএফ তাঁকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জন্মভূমির এমন আচরণে তিনি ভীষণ হতাশ। তিনি বলেন, ‘এই দেশ আমার, কিন্তু আমি এই দেশের না।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
এই বছরের নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি। ২৪ জুন অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বের নির্বাচনে তিনি নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোসহ প্রায় এক ডজন প্রার্থীকে পরাজিত করে রীতিমতো ইতিহাস গড়েছেন।
১ ঘণ্টা আগেনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আরব কর্মকর্তা বলেন, ‘গাজা, লেবানন, সিরিয়া ও এখন ইরান—সবখানেই তিনি (নেতানিয়াহু) নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামছাড়া শক্তি আর আমাদের জন্য সম্পদ নয়। এটি এখন আমাদের জন্য সমস্যা।’
১ দিন আগেডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি রাখতে ও ন্যাটোকে এক রাখার চেষ্টায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে সাম্প্রতিক ন্যাটো সম্মেলনে প্রায় সবকিছুই করেছে জোটটি। ঢালাও প্রশংসা, রাজকীয় আপ্যায়ন আর ট্রাম্পের বিখ্যাত স্লোগান নকল করাও বাদ যায়নি। পরিকল্পনা মোটামুটি সফল। যদিও ইউক্রেনে যুদ্ধ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কৌশল বা ইউরোপে মার্কি
১ দিন আগেইসরায়েল-ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয় যুদ্ধ শেষের ঠিক আগ মুহূর্তে। ইরানের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের মরুভূমি শহর বীর শেবা। সেখানে গত মঙ্গলবার ভোর ৬টার কিছু আগে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। বিস্ফোরণে একটি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একপাশ সম্পূর্ণ উড়ে যায়। পরে ভবনের
১ দিন আগে