Ajker Patrika

যতীন সরকার: যিনি বইয়ের আদর্শ আর জীবনের আদর্শকে এক করেছিলেন

চিররঞ্জন সরকার
যতীন সরকার। ছবি: সংগৃহীত
যতীন সরকার। ছবি: সংগৃহীত

যতীন স্যারকে নিয়ে কথা বলতে বসলে মনে হয়, কথাগুলো শুধু লেখা নয়—এ যেন হৃদয়ের ভেতরের কিছু টুকরো তুলে ধরা। দুপুরে হঠাৎ এক সুহৃদ ফোন করে বলল, ‘শুনেছ? যতীন স্যার নেই!’—মুহূর্তেই আমার বুক কেঁপে উঠল। মনে হলো, জীবনের এক অমূল্য আশ্রয় হঠাৎ হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে তিনি শুধু প্রথিতযশা লেখক বা বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা নন—তিনি ছিলেন এক জীবন্ত পাঠশালা, ছিলেন এমন এক অভিভাবক, যাঁর চোখের গভীরে ছিল প্রজ্ঞার আলো আর হৃদয়ে ছিল অফুরন্ত মমতা। খবরটা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে, এক বিশাল বটবৃক্ষ হঠাৎ তার ছায়া সরিয়ে নিয়েছে। যে ছায়াতলে বসে আমি বহুবার জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর জীবনবোধের পাঠ নিয়েছি—আজ সেই ছায়া নেই। এই শূন্যতা বুকের ভেতরে এক গভীর প্রতিধ্বনির মতো বাজছে আর আমি জানি, এ ফাঁক কোনো দিন পূরণ হবে না।

যতীন স্যারের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে। তখন তাঁর লেখা পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন কিংবা লোকসংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধগুলো আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ১৯৯৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ‘গণ সাহায্য সংস্থা’য় চাকরি নিয়ে যখন ময়মনসিংহে গেলাম, তখনই প্রথম সামনে পাই তাঁকে। পেশাগত কারণে সেখানে দুই বছর কাটিয়েছিলাম। স্যার তখন কলেজে পড়াতেন, আর ময়মনসিংহের সবাই তাঁকে স্যার বলত। সঙ্গত কারণেই আমিও বলতাম। আসলে, এমন মানুষকে স্যার না বলে ডাকা যায়ই না—এটা ছিল শুধু সম্মানের প্রশ্ন নয়, বরং ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতারও প্রকাশ। তাঁর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আজ মনে হচ্ছে, বুকের ভেতরে জমে থাকা অমূল্য ধন—যা সময়ের কোনো ঝড়েই হারাবে না।

মূলত কর্মসূত্রেই যতীন স্যারের সঙ্গে পরিচয়। যতীন স্যারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে অথচ কেউ তাঁর প্রতি মুগ্ধ হবেন না—তা হয় না, হতে পারে না। আমিও প্রথম পরিচয়েই স্যারের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তখন এমন একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছিল যে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় স্যারের হিন্দুপল্লির সেই ছোট বাসায় যেতাম। আড্ডা, হাস্যরস, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত আলোচনা। এ আনন্দাসরে নিয়মিত উপস্থিত হতে আমি একটু কুণ্ঠিত হতাম—মাসিমার কথা ভেবে। প্রায়ই বেশি রাত হয়ে যেত। স্যার পীড়াপীড়ি করতেন রাতের খাবারের জন্য। আর এই ধকলটা শেষপর্যন্ত মাসিমার কাঁধে বর্তাত।

প্রাণরসে টইটম্বুর এমন হাস্যোজ্জ্বল প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। তিনি যেমন হাসতে পারেন, তেমন পারেন হাসাতে। লৌকিক বাংলার হাসির হেন কোনো উপাদান নেই, যা যতীন স্যার জানেন না। কেন্দুয়ার আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন, কিন্তু যা বলতেন উচ্চস্বরে এবং জোর দিয়ে বলতেন। ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য, দর্শন, লৌকিক ঐতিহ্য—এসব বিষয় নিয়ে যতীন স্যারের চেয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা বাংলা ভাষায় আর কে লিখেছে? স্যারের লেখা প্রাঞ্জল, তাঁর বাংলা অন্য কাউকে অনুবাদ করে দিতে হয় না!

জ্ঞান, প্রজ্ঞা, রসবোধ, জীবনবোধ—সবকিছুই যতীন স্যারের অসাধারণ। যতীন স্যার আমার কাছে একজন জ্ঞানতাপস। জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। বইয়ের আদর্শ আর জীবনের আদর্শ—এই দুইকে এক করে জীবনচর্চাকারী হিসেবে যতীন স্যারের বাইরে দ্বিতীয়জনকে দেখিনি। ইহজাগতিক লোভ-লাভ, এমনকি খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে সারা জীবন মফস্বলে কীভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায়—যতীন স্যার এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে যেমন বলেছিলেন, ‘আমি যে কাজ করেছি, সেই কাজ খুবই অকিঞ্চিৎকর,’—এই বিনয়ী মনোভাব তাঁর ব্যক্তিত্বের এক উজ্জ্বল দিক। কিন্তু আমি জানি, এই বিনয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল জ্ঞানের এক বিশাল সমুদ্র।

তিনি যে লোকসংস্কৃতিকে একটি জাতির প্রকৃত সংস্কৃতি বলে মনে করতেন, তার পেছনে ছিল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গভীর বিশ্লেষণ। তাঁর মতে, সমস্ত সংস্কৃতির উৎসমূলই হচ্ছে লোকসাধারণ। এ দর্শন থেকে তিনি ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের খণ্ডিত দৃষ্টি থেকে মুক্ত করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, ব্রিটিশ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার কডওয়েল ও জর্জ টমসনের কাজ অনুসরণ করে ফোকলোর চর্চায় নতুন দিশা পাওয়া সম্ভব।

যতীন সরকার শুধু একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজসচেতন মানুষ। রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল খুবই স্পষ্ট। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, কিন্তু পরে লুটেরা ও ধনিক শ্রেণির হাতে সেই অর্জন চলে গেছে। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য তিনি জনগণের মধ্যে নতুন চেতনার জাগরণ দেখতে চেয়েছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও তাঁর ভাবনা ছিল সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর মতে, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে শিক্ষানীতির কোনো জোড়াতালিই কার্যকর হবে না। একজন মার্ক্সবাদী চিন্তক হিসেবে তিনি ‘মার্ক্সবাদ’ শব্দটির বদলে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী’ শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। কারণ, তাঁর মতে, এটিই যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এতে তিনি আশাবাদী ছিলেন।

যতীন সরকার যে শিল্পসাহিত্যকে জীবনের জন্য ও সমাজের পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য মনে করতেন, তার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর সাক্ষাৎকারে। তিনি ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ বা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কাছে সাহিত্য মানুষের উত্তরণের হাতিয়ার। বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্য নিয়েও তিনি আশাবাদী ছিলেন, কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘বাদ ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই প্রকৃত সত্য গর্জে ওঠে।’ সাহিত্যিকদের মধ্যে দলাদলি দেখে তিনি বিচলিত হননি, বরং একেই তিনি তত্ত্বের গর্জে ওঠার মাধ্যম হিসেবে দেখতেন। তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণের বাস্তব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি সাহিত্যকে অবমূল্যায়ন করেছেন।

আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা, তাঁর দর্শন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে। তাঁর বিনয়ী স্বীকারোক্তি, ‘আমি যে কাজ করেছি, সেই কাজ খুবই অকিঞ্চিৎকর,’ আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, মহান মানুষেরাই নিজেদের কাজকে ছোট করে দেখেন। কারণ, তাঁদের লক্ষ্য থাকে আরও বড়। যতীন সরকার আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তা ও আদর্শ আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

ভারতকে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

অস্থিরতার সামান্য ইঙ্গিত পেলেই আমরা চলে যাব

জি এম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার

প্লট–ফ্ল্যাট বরাদ্দে সচিব, এমপি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ যাঁদের কোটা বাতিল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত