বিভুরঞ্জন সরকার

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।
রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।
শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।
আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।
প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।
এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।
রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।
শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।
আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।
প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।
এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।
বিভুরঞ্জন সরকার

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।
রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।
শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।
আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।
প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।
এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।
রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।
শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।
আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।
প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।
এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
১ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
২ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৬ দিন আগেসম্পাদকীয়

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।
ছবি: সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ,
০৬ আগস্ট ২০২৫
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
১ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
২ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৬ দিন আগেসম্পাদকীয়

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁর সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রসঙ্গে আলাপ করেছি, যা হয়তো অত স্বচ্ছন্দে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে করতে পারতাম না। যেমন ধরেন যৌনতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো। তবে আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বের জন্যও তাঁর সাক্ষাৎকারটি হয়েছে অনেক প্রাণবন্ত। তাঁকে তো বাম ঘরানার লেখকই ধরা হয়, মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কিন্তু গোঁড়া মার্ক্সবাদী ছিলেন না।
আমি এ ব্যাপারটিও তাঁর সঙ্গে খোলাসা করার জন্য আলাপ করেছি। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের নামে একসময় একধরনের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ চর্চা হয়েছে সাহিত্যে। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এ সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, এ দেশের মার্ক্সবাদীদের অনেক জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তিনি তাঁর লেখায় জীবনকে একেবারে ভেতর থেকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অহেতুক শ্রমিকশ্রেণির জয়গান গাননি, লাল পতাকা ওঠাননি। আমার সাক্ষাৎকারে সেক্সের সঙ্গে ক্লাস পজিশনের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে। তিনি এও বলছেন, তাঁর চিলেকোঠার সেপাইয়ের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির যে চরিত্র, তাকে তিনি মহান করে দেখাননি, শুধু শ্রমিকশ্রেণির বিজয়গাথা তিনি দেখাননি।
বরং হাড্ডি খিজির যে একটি লুম্পেন চরিত্র, তার ভেতর যে নানা জোচ্চুরি আছে, সেটাকেও দেখিয়েছেন। এই যে মানুষকে টোটালিটিতে দেখতে এবং দেখাতে পারা, এটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শক্তি।
তো এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হতো তাঁর সঙ্গে, সেটাকেই আমি সাক্ষাৎকারে ধরতে চেষ্টা করেছি।
সূত্র: মঞ্জুরুল আজিম পলাশ কর্তৃক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘দূরগামী কথার ভেতর’, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁর সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রসঙ্গে আলাপ করেছি, যা হয়তো অত স্বচ্ছন্দে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে করতে পারতাম না। যেমন ধরেন যৌনতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো। তবে আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বের জন্যও তাঁর সাক্ষাৎকারটি হয়েছে অনেক প্রাণবন্ত। তাঁকে তো বাম ঘরানার লেখকই ধরা হয়, মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কিন্তু গোঁড়া মার্ক্সবাদী ছিলেন না।
আমি এ ব্যাপারটিও তাঁর সঙ্গে খোলাসা করার জন্য আলাপ করেছি। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের নামে একসময় একধরনের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ চর্চা হয়েছে সাহিত্যে। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এ সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, এ দেশের মার্ক্সবাদীদের অনেক জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তিনি তাঁর লেখায় জীবনকে একেবারে ভেতর থেকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অহেতুক শ্রমিকশ্রেণির জয়গান গাননি, লাল পতাকা ওঠাননি। আমার সাক্ষাৎকারে সেক্সের সঙ্গে ক্লাস পজিশনের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে। তিনি এও বলছেন, তাঁর চিলেকোঠার সেপাইয়ের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির যে চরিত্র, তাকে তিনি মহান করে দেখাননি, শুধু শ্রমিকশ্রেণির বিজয়গাথা তিনি দেখাননি।
বরং হাড্ডি খিজির যে একটি লুম্পেন চরিত্র, তার ভেতর যে নানা জোচ্চুরি আছে, সেটাকেও দেখিয়েছেন। এই যে মানুষকে টোটালিটিতে দেখতে এবং দেখাতে পারা, এটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শক্তি।
তো এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হতো তাঁর সঙ্গে, সেটাকেই আমি সাক্ষাৎকারে ধরতে চেষ্টা করেছি।
সূত্র: মঞ্জুরুল আজিম পলাশ কর্তৃক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘দূরগামী কথার ভেতর’, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ,
০৬ আগস্ট ২০২৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
২ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৬ দিন আগেসম্পাদকীয়

১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায় শিয়ালবাড়ি এলাকায়। মিরপুরের প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজের দিকে যেতে একটি কালভার্ট ছিল। এখন যদিও রাস্তার মাঝে ঢাকা পড়েছে। সেখানেই ৬০টি বস্তায় প্রায় ৩৫০টি মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের পাশের কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য লাশ। ৬ নম্বর লেনের শেষ প্রান্তের মাঠে স্তূপাকারে পড়ে থাকা দুই শতাধিক লাশ শিয়ালবাড়ি গণকবরে কবর দেওয়া হয়। এটি ছিল ১০ কাঠা জমির ওপর। বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু অংশ বাকি আছে, তা বর্তমানে মাতবরবাড়ি পারিবারিক কবরস্থান। শিয়ালবাড়ির যেসব কুয়ায় শহীদদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে এখন বহুতল ভবন, কারখানা, শপিং মল।
তথ্য ও ছবি: মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি, মিরাজ মিজু

১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায় শিয়ালবাড়ি এলাকায়। মিরপুরের প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজের দিকে যেতে একটি কালভার্ট ছিল। এখন যদিও রাস্তার মাঝে ঢাকা পড়েছে। সেখানেই ৬০টি বস্তায় প্রায় ৩৫০টি মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের পাশের কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য লাশ। ৬ নম্বর লেনের শেষ প্রান্তের মাঠে স্তূপাকারে পড়ে থাকা দুই শতাধিক লাশ শিয়ালবাড়ি গণকবরে কবর দেওয়া হয়। এটি ছিল ১০ কাঠা জমির ওপর। বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু অংশ বাকি আছে, তা বর্তমানে মাতবরবাড়ি পারিবারিক কবরস্থান। শিয়ালবাড়ির যেসব কুয়ায় শহীদদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে এখন বহুতল ভবন, কারখানা, শপিং মল।
তথ্য ও ছবি: মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি, মিরাজ মিজু

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ,
০৬ আগস্ট ২০২৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
১ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ,
০৬ আগস্ট ২০২৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
১ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
২ দিন আগে