Ajker Patrika

টাং টাইড: ঐতিহ্যের অভিনব প্রদর্শন

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
টাং টাইড: ঐতিহ্যের অভিনব প্রদর্শন

ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গিয়ে যদি আপনি দেখেন, একটি আস্ত নোনা ইলিশ ডালিম মুখে নিয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে সুদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে, ধাক্কা তো লাগারই কথা—   তাই না? কিংবা যদি দেখেন আপনার খুব প্রিয় খাবার গরুর ভুঁড়ির অবয়বটি একটি পাখির মতো, অথবা আপনার পরিচিত কলার মোচা, বিট ও রঙিন বাঁধাকপি ব্যবচ্ছেদের পর অদ্ভুত রং ছড়িয়েছে, দু’দণ্ড ভাবতেই হবে। বুঝতে চাইবেন, শিল্পী কী বলতে চাইছেন। নিজের অজান্তেই আপনি নিজেও অনেক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে পারেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

বিষয়টি বেশ অভিনব, অন্তত আমার কাছে। খাবারের বিভিন্ন উপকরণ কিংবা আস্ত খাবার নিয়েই এন্তার ছড়া, কবিতা, গল্প উপন্যাস আছে। আছে গবেষণামূলক বই। তাতে খাবারের আদি অন্ত পাওয়া যায়। কিন্তু খাবারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে প্রদর্শনী? সেটা অভিনব বিষয়ই বটে। কিন্তু সে অভিনব কাজটিই করেছেন আলোকচিত্রী হাবিবা নওরোজ। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী হাবিবা নওরোজের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স জিল গাহাসোঁ

প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি, বিকেল বেলা। উদ্বোধনের পর শিল্পীর সঙ্গে বেশ দীর্ঘ সময় আলাপ হয় আমার। খাবার নিয়ে এমন অভিনব আয়োজনই আমাকে টেনে নিয়ে যায় প্রদর্শনীটি বিষয়ে আরও খানিক খোঁজখবর করার দিকে। খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখি, এর মধ্যে ব্যাপক ভাঙাগড়া আছে, আছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ও তার অভিঘাতে সংস্কৃতিগত ধস। আছে আমাদের সমাজ মানসের ব্যাপক প্রতিফলন এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাওয়া এক আলোছায়ার শিল্পীর অন্তর্গত রক্তক্ষরণ ও গভীর অভিনিবেশ। শুরুটা হয় করোনাকালে ঢাকায় প্রথম লকডাউনের সময়। সে সময় এক বিহ্বল আলোকচিত্রী টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলেন ত্রাণের ট্রাক থেকে মানুষ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মতো করে। ঘটনাটি যশোরের হলেও নওরোজের মনে রেখাপাত করে। তিনি বলেছিলেন যে, সে দৃশ্য তাঁর কাছে ছিল ‘ডিস্টার্বিং ডিস্টোপিক’। এরপর থেকে তিনি খাদ্যের অপচয় বিষয়ে বেশ কিছু ছবি তোলেন। কিন্তু সেগুলো তাঁকে ঠিক শান্তি দিচ্ছিল না।

একটি শিল্পকর্মদ্বিতীয় লক ডাউনের সময় তিনি আবারও কাজ শুরু করেন। সে সময়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভর করে তাঁর ওপর। তিনি খুঁজে পান ‘কুটুম কাটাম’ নামের বইটি। ১৯৩০ এর দশকের পর থেকে অবনীন্দ্রনাথ বাগানে পরে থাকা কাঠের টুকরা দিয়ে খেলনা বানাতে শুরু করেছিলেন। সেগুলোকে তিনি বলতেন ‘বন্ধু শিল্প’। সে ধারণাটি থেকে বেশ প্রভাবিত হন নওরোজ। তারপর শুরু করে ঐতিহ্যবাহী খাবারের উপাদানগুলো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আলোকচিত্রী হাবিবা নওরোজের টাং টাইড প্রদর্শনীটির প্রেক্ষাপট। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে নিছক একজন সংবেদনশীল আলোকচিত্রীর ব্যক্তিগত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ বলতে পারেন অনেকে। 

কিন্তু একবার খেয়াল করলে দেখবেন, এই নয়া উদারতাবাদের অর্থনীতি যেভাবে কালচারাল হোমোজেনাইজেশন ঘটায় এবং স্থানীয় সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন করে, তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরে স্থানীয় খাদ্যসংস্কৃতির ওপর। আমরা যত সহজে নিজেদের খাবারগুলো ভুলতে শুরু করি, সেটা অবিশ্বাস্য। আমাদের গ্রামীণ পরিসর পর্যন্ত কোমল পানীয়ের ব্যাপক প্রচলনের কথা একবার ভেবে দেখুন। এক সময় মানুষ ক্লান্ত হলে বা অতিথি আপ্যায়নের জন্য বেছে নিতেন ডাবের পানি কিংবা নিদেন পক্ষে লেবুর শরবত। এখন সেটা দখল করেছে ফ্রিজে রাখা চিল্ড সফট ড্রিংকস। আবার খেয়াল করে দেখুন তো, মেলা ছাড়া এখন কদমা কিংবা বাতাসা পাওয়া যায় কি না? যত সহজে ধূমায়িত স্টেক খেতে পারি আমরা তত সহজে অভিজাত কোনো রেস্তোরাঁয় শুঁটকি খাওয়া কথা চিন্তাই করতে পারি না। তার চেয়েও বড় কথা, স্টেক পাওয়া যায় যে ধরনের রেস্তোরাঁয় সে ধরনের রেস্তোরাঁয় শুঁটকি দিয়ে তৈরি কোনো খাবারই পাওয়া যায় না। এর কারণ কালচারাল হোমোজেনাইজেশন বা সাংস্কৃতিক সমজাতকরণ। এই ‘সমজাতকরণ’ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি আর বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শক্তিশালী আগ্রাসী মনোভাব, যা সব সময় যুদ্ধের বাইরে ছড়িয়ে পরে এক অদ্ভুত কোমলতায়। কিন্তু এই ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করা হয় সুচতুর ভাবে। 

উদ্বোধনী দিনে দর্শকদের একাংশহাবিবা নওরোজের ‘টাং টাইড’ শিরোনামের প্রদর্শনীটি দেখতে দেখতে খাদ্য উপকরণগুলোর এক বিবর্ণ চিত্র আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে। যে চিত্রে দেখা যাবে আপনার ঐতিহ্যবাহী খাবার ধীরে ধীরে রেড বুকে উঠে যাচ্ছে; যার অর্থ হলো, আপনার ঐতিহ্যগত চেনা স্বাদ প্রায় বিলুপ্তির পথে। 

প্রদর্শনীটি ১০ মার্চ পর্যন্ত চলবে। দেখে আসতে পারেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতীয় বিমানবন্দরে ১১ দিন ধরে পড়ে আছে ব্রিটিশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, ঘনাচ্ছে রহস্য

ইরানের ‘দানবীয় ক্ষেপণাস্ত্রের’ সামনে উন্মুক্ত ইসরায়েলের ‘অ্যাকিলিস হিল’

জোহরান মামদানি শতভাগ কমিউনিস্ট উন্মাদ, চেহারা বাজে ও বুদ্ধি কম: ট্রাম্প

সারজিস আলমের পোস্ট: সেই সাবরেজিস্ট্রারের অফিসে দুদকের অভিযান

সমীক্ষা-সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ২০ হাজার কোটির দুই প্রকল্প

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত