Ajker Patrika

বস্তির ফুটবল থেকে বলিউডের মুভিতে

বস্তির ফুটবল থেকে বলিউডের মুভিতে

২০০১ সালের এক বৃষ্টি ভেজা এক বিকেল। নিজের প্রাত্যহিক কাজ সেরে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন নাগপুরের হিসলোপ কলেজের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক বিজয় বারসে। বৃষ্টির ঝাপটা একটু বেশি থাকায় বাধ্য হয়ে এক গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হলো বিজয়কে। একা একা গাছের নিচে যখন কল্পনার রাজ্যে ডুব দিতে যাবেন যখন, তখনই কানে এলো একদল শিশু-কিশোরের হইচই।

নাগপুরের বিদর্ভ হকি অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ছোট একটা মাঠ আছে। আশপাশের বস্তির একদল শিশু সেই মাঠে গায়ে কাঁদা মেখে মনের আনন্দে লাথি মারছিল ময়লা ফেলার এক ঝুড়িতে। বিজয়ের মাথায় তখনই ভর করল ভাবনা, ‘আচ্ছা, ঝুড়ির বদলে এদের পায়ে একটা বল দিলে কেমন হয়?’ যেই ভাবা, সেই কাজ! এরপর বাকিটা ইতিহাস।

২১ বছর আগের বৃষ্টি ভেজা বিকেলে আসা ভাবনাটা বদলে দিয়েছে ৭৭ বছর বয়সী বিজয় বারসের জীবন। অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলকে বস্তির শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঝোপাদপত্তি ফুটবল একাডেমি। তবে সবার কাছে এই একাডেমি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘বস্তির ফুটবল’ নামে। 

বস্তির শিশুদের নিয়ে বিজয় বারসের পথ চলা যেন কোনো রূপকথাএই একাডেমি নিয়ে বিজয়ের সংগ্রাম, স্বপ্ন আর পথচলার গল্প এবার দেখবে সারা বিশ্ব। বস্তির এই ফুটবল নিয়ে বলিউডে নির্মাণ হতে যাচ্ছে বড় বাজেটের সিনেমা, নাগরাজ মানজুলে পরিচালিত ‘ঝুন্ড’ নামের সিনেমায় বিজয়ের চরিত্রে দেখা যাবে বলিউডের ‘শাহেনশাহ’খ্যাত অমিতাভ বচ্চনকে! 

দুই দশক আগের সেই বিকেলের দৃশ্যটা এখনো ঝকঝকে বিজয়ের মানসপটে। মনে আছে পরদিন খুব সকালে উঠেছিলেন। গিয়েছিলেন নাগপুরের পাশের এক বস্তিতে। দেখলেন সেই বস্তির শিশুরাও ফুটবলকে ভালোবাসে এবং তাদেরও আছে বলের সংকট। তারপরও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থেকে রাবারের একটা বল নিয়েই এই শিশুরা তাদের রোজকারের খেলা চালিয়ে যায়। শিশুদের এই ইচ্ছাটাকে কাজে লাগালেন বিজয়, বললেন পাশের বস্তির শিশুদের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলতে তারা আগ্রহী কিনা। কোনো আপত্তি ছাড়াই দলটা রাজি হয়ে গেল, বাস্তবতায় রূপ নিতে শুরু করল বিজয়ের স্বপ্ন। 

বস্তির দুই দলের ফুটবলারদের খেলার প্রতি আনন্দ আর রোমাঞ্চটাই বিজয়কে দেখাল পথ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে সাবেক এই শিক্ষক শুনিয়েছেন সেদিনের সেই গল্পটা। বলছিলেন, ‘ছেলেগুলো সময়ের আগেই হাজির হয়েছিল। দেখলাম ম্যাচটা নিয়ে দেখি সবাই খুব উত্তেজিত। যে যার নিজের ভালো পোশাকটাই পরে এসেছে। বিশ্বাস করুন, সবার চোখে ফুটবলকে ঘিরে আমি অন্য এক ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলাম। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের পথচলা।’

অমিতাভের সঙ্গে বিজয় বারসে। সিনেমায় বিজয়ের চরিত্রে অভিনয় করবেন তিনিবস্তির শিশুদের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে কাজে লাগিয়ে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করলেন বিজয়। স্থানীয় গণমাধ্যমের সাহায্যে জানিয়ে দেওয়া হলো টুর্নামেন্টে অংশ নিলে মিলবে বিনা মূল্যে খাবার, ট্রফি আর পুরস্কার। কলেজের ছাত্রদেরও কাজে লাগালেন প্রচার প্রচারণায়। টুর্নামেন্টের আগে কতগুলো দল নিবন্ধন করল তার খোঁজ নিতে গিয়ে কপালে চোখ ওঠার দশা বিজয়ের। 

 ‘১২৮ দল নিবন্ধন করেছে শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম! ছাত্রদের বললাম দ্রুত নিবন্ধন বন্ধ করো। ১২৮ দলকে সামলানো আমার জন্য ছিলাম পাহাড় ঘাড়ে তোলার মতো দায়িত্ব। তবে একই সঙ্গে এই শিশুদের ফুটবল প্রেমটাও আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল।’ 

টুর্নামেন্টে কোনো ধরা-বাধা নিয়ম ছিল না। ছিল না কোনো জার্সি। খালি পায়ে বাচ্চারা খেলেছে মনের আনন্দে। টুর্নামেন্টে রেফারির দায়িত্ব নিজে পালন করেছেন বিজয়। ফুটবলারদের শিখিয়েছেন প্রতিপক্ষকে ঘৃণা নয়, শ্রদ্ধা করতে শেখ। সেই টুর্নামেন্টটাই পরে ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে বৃহৎ এক যজ্ঞে। 

শুধু ফুটবল খেলানোই নয়, বিশাল একটা দায়িত্বও কাঁধে চেপে বসে বিজয়ের। তার ফুটবলারদের অধিকাংশই ছিল পেশাদার পকেটমার, ছিঁচকে চোর নয়তো মাদকাসক্ত। অপরাধের পথ থেকে সরিয়ে শিশুদের ফুটবলে মনোযোগী করাও ছিল বিজয়ের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আবার এই শিশুদের অনেকেই ছিল পরিবারের আয়ের বড় একটা খুঁটি। অভিভাবকেরা রোজগার করা একটা শিশুকে খেলতে পাঠাবে কিনা তা নিয়েও ছিল সংশয়। 

তাই অভিনব একটা পন্থা আঁটলেন বিজয়। নিজে দরিদ্র পরিবারের ছেলে হওয়ায় বিজয় জানতেন সব মা-বাবাই চায় অপরাধের পথে থেকে সরে এসে তার সন্তান একটি সৎ জীবন বেছে নিক। বিনয়ী ফুটবলারদের মা-বাবাকে টেলিভিশনের পর্দায় সাক্ষাৎকার দেওয়ালেন বিজয়। তাদের দেখাদেখি অন্য অভিভাবকেরাও আগ্রহী হলেন। মেয়ে ফুটবলারদের জন্য ব্যবস্থা করলেন নারী স্বেচ্ছাসেবক। সেই থেকে বাড়তে লাগল বিজয়ের কাজের পরিধি, তার দল পৌঁছে গেল পথশিশুদের বিশ্বকাপের মঞ্চে। 

পথশিশুদের বিশ্বকাপ অন্য টুর্নামেন্ট থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। বিশ্বকাপে খেলতে হলে খেলোয়াড়কে অন্তত ১৬ বছর বয়সী হতে হবে। জীবনের অন্তত একটা সময়ে থাকতে হবে গৃহহীনভাবে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো একজন ফুটবলার কেবল জীবনে একবারই এই বিশ্বকাপে খেলতে পারবে। 

বিজয় জানতেন এই বিশ্বকাপে খেলতে পারলে তার দল গণমাধ্যমের বড় একটা প্রচার পাবেন। তাই বিশ্বকাপের খরচ জোগাতে বন্ধক রাখলেন নিজের ঘর আর সেই বন্ধকের টাকায় ফুটবলারদের জন্য কিনলেন বুট আর জার্সি। বন্ধকের টাকাতেও খরচ কুলাচ্ছে না দেখে ফুটবলারদের নিয়ে হাত পাতলেন সাধারণ মানুষের কাছে। এভাবে দানের টাকা দিয়ে ২০০৭ সালে কোপেনহেগেনে প্রথমবারের মতো পথশিশুদের বিশ্বকাপে অংশ নেয় বিজয়ের দল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত টানা ১২টি বিশ্বকাপে খেলেছে দলটি। 

এক শহর থেকে বিজয়ের বস্তি ফুটবল ছড়িয়েছে সারা ভারতে। সারা দেশের ১০০ শহর ও ২৪টি রাজ্যের পথ শিশুরা খেলে এই টুর্নামেন্টে। জাতীয় পর্যায়েও এখন পথশিশুদের টুর্নামেন্ট আয়োজিত করা হয় ভারতে। যত কিছুই হোক বিজয় বারসে একটা বিষয় সব সময়ই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, পথশিশুরা স্কুলে যাবে নিয়মিত আর ভালোবাসবে ফুটবল। 

এই সংগ্রামী পথচলা নিয়ে ২০১৮ সালে নাগরাজ মানজুলে সিনেমা নির্মাণের অনুমতি চাইলেও শুরুতে নাই করে দিয়েছিলাম বিজয় বারসে। নাগরাজ মানজুলে যখন জানালেন তার চরিত্রে অভিনয় করবেন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন তখন অবশ্য আর অনুমতি না দিয়ে পারেননি বিজয়, ‘আমি অমিতাভের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি তিনি রীতিমতো আমাকে নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি হুবহু আমার মতে করে বসলেন। তাঁকে বললাম অবশেষে আপনি সত্যিকারের বিজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। শুনে তিনি হেসেছেন আর আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার জন্য এটাই অনেক!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ না করার প্রস্তাব

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত