Ajker Patrika

৫০ কোটি বছর আগে ছিল তিন চোখা শিকারি, পাওয়া গেল জীবাশ্ম

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ১৫: ১১
সি মথের মাথায় ছিল তিনটি চোখ এবং দাঁত দিয়ে ঘেরা একটি বৃত্তাকার মুখ। ছবি: ড্যানিয়েল ডিফল্ট
সি মথের মাথায় ছিল তিনটি চোখ এবং দাঁত দিয়ে ঘেরা একটি বৃত্তাকার মুখ। ছবি: ড্যানিয়েল ডিফল্ট

প্রায় ৫০ কোটি বছরেরও বেশি সময় আগে সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়ানো এক রহস্যময় শিকারির জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন জীবাশ্মবিদেরা। তিনটি চোখ এবং পেনসিল শার্পনারের মতো গোল মুখবিশিষ্ট এই অদ্ভুত আকৃতির প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে মোসুরা ফেনটনি (Mosura fentoni)। এ ছাড়া প্রাণীটির ডাকনাম রাখা হয়েছে ‘সি মথ’।

কানাডিয়ান রকি অঞ্চলে বার্গেস শেল অঞ্চলে পাওয়া জীবাশ্মটি প্রাণিজগতের এক অতি প্রাচীন যুগ, ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডের এক নতুন চিত্র উপস্থাপন করেছে। সম্প্রতি ‘রয়েল সোয়াইটি ওপেন সায়েন্স’ জার্নালে এ নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।

২০ শতকের গোড়ার দিকে প্রথমবার জীবাশ্মটি আবিষ্কার করেন প্যালিওনটোলজিস্ট চার্লস ওয়ালকট। তবে তখন তা গুরুত্ব পায়নি। মোট ৬০টিরও বেশি জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে মোসুরা ফেনটনির পূর্ণ গঠন উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে।

পরবর্তী জীবাশ্মগুলো ১৯৭৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামের গবেষকেরা সংগ্রহ করেন। নতুন জীবাশ্মগুলোর সন্ধান মেলে কানাডার কুটেনি ন্যাশনাল পার্কে বার্গেস শেলের নতুন আবিষ্কৃত অংশে।

মানিটোবা মিউজিয়াম এবং রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামের গবেষকেরা জানিয়েছেন, এই শিকারি প্রাণীটি আকারে মানুষের তর্জনীর সমান। এর মাথায় ছিল তিনটি চোখ এবং দাঁত দিয়ে ঘেরা একটি বৃত্তাকার মুখ। সাঁতারের জন্য উভয় পাশে ছিল পাখনার মতো গঠন, এবং মাথার সামনের দিকে ছিল দুটি বিশাল ধারালো থাবা বা নখর।

অন্যান্য রেডিওডন্টদের মতো জালযুক্ত না হয়ে প্রাণীটির থাবা ছিল দীর্ঘ, মসৃণ ও কাঁটাযুক্ত। যেগুলোর ডগা ছিল দ্বিখণ্ডিত। এতে বোঝা যায়, মোসুরা সম্ভবত ছোট শিকারকে ধরে মুখের দিকে ঠেলে দিত।

গবেষণার প্রধান লেখক এবং মানিটোবা মিউজিয়ামের কিউরেটর জো মোইসিয়ুক বলেন, ‘এর মাথার সামনের অংশে যুগ্ম নখর আছে, যেগুলোতে দীর্ঘ কাঁটার মতো অংশ রয়েছে। দেখতে অনেকটা এডওয়ার্ড সিজারহ্যান্ডসের মতো।’

উল্লেখ্য, এডওয়ার্ড সিজারহ্যান্ডস হলো একটি কাল্পনিক চরিত্র, যার হাতের বদলে কাঁচির মতো ধারালো ব্লেড থাকে।

মোসুরা হচ্ছে রেডিওডন্ট নামের একটি বিলুপ্ত প্রাণীগোষ্ঠীর সদস্য, যারা আর্থ্রোপডদের (যেমন: পোকামাকড়, কাঁকড়া, মাকড়সা) বিবর্তনীয় পূর্বপুরুষ। এই রেডিওডন্ট গোষ্ঠীর অন্তর্গত প্রাণীটি তার আত্মীয়দের তুলনায় অনেক বেশি জটিল গঠনের ছিল বলে মনে করছেন গবেষকেরা। যেখানে অন্যান্য রেডিওডন্টদের পেছনের অংশটা ছিল অপেক্ষাকৃত সাধারণ, সেখানে মোসুরার দেহে ছিল ১৬টি খণ্ড বা সেগমেন্ট, প্রতিটিই আধুনিক আর্থ্রোপডদের মতো গিল বা শ্বাসপ্রশ্বাসের অঙ্গ দিয়ে আবৃত।

উল্লেখ্য, আজকের ৮০ শতাংশ জীবিত প্রাণীই আর্থ্রোপড গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

২০ শতকের গোড়ার দিকে প্রথমবার জীবাশ্মটি আবিষ্কার করেন প্যালিওনটোলজিস্ট চার্লস ওয়ালকট। ছবি: জিন-বার্নার্ড ক্যারন

মোইসিয়ুক বলেন, ‘এই বহু খণ্ডবিশিষ্ট পেছনের অংশ এই প্রজাতিতে প্রথম দেখা গেল। এর অর্থ হচ্ছে, এই প্রাণীরা তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ পরিবর্তন করে নানা ধরনের কার্যক্ষমতার জন্য বিশেষায়িত করতে পারত—যেটা আজকের অনেক জীবন্ত প্রাণীদের মধ্যেও দেখা যায়।’

এই জীবাশ্মগুলো এতটাই ভালোভাবে সংরক্ষিত যে বিজ্ঞানীরা তাতে স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র এবং রক্ত সংবহন পদ্ধতির চিহ্নও দেখতে পেয়েছেন। এর ওপেন সার্কুলেটরি সিস্টেম অর্থাৎ খোলা রক্ত সংবহন পদ্ধতি বিশ্লেষণে দেখায় যায় একটি হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত সরাসরি শরীরের বড় গহ্বরে প্রবাহিত হতো।

এই ‘সি মথ’ সম্ভবত আধুনিক স্টিংরের (একধরনের সামুদ্রিক মাছ) মতো শরীরের ফ্ল্যাপ ব্যবহার করে সাঁতার কাটত। এটি শিকার করত সেই সময়কার অন্য রেডিওডন্টদের সঙ্গে, যাদের মধ্যে ‘Anomalocaris canadensis’ ছিল একপ্রকার শীর্ষ শিকারি।

যদিও সরাসরি শিকারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে সে সময় মোসুরা যেসব প্রাণীর সঙ্গে বসবাস করত তার মধ্যে ছিল একর্ন ওয়ার্ম, ব্রিসল ওয়ার্ম ও ছোট আকারের আর্থ্রোপড। এই প্রাণীগুলো হয়তো মোসুরার খাদ্য ছিল।

মোসুরার জীবাশ্ম বর্তমানে রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামের ‘ডন অব লাইফ’ প্রদর্শনীতে স্থায়ীভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

কানাডার ম্যানিটোবা মিউজিয়ামেও শিগগিরই একটি মোসুরা জীবাশ্ম প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টোরির প্যালিওবায়োলজিস্ট স্টুয়ার্ট এডি বলেন, মোসুরার আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন শুরু হওয়ার আগেই পৃথিবীতে জীবনের বৈচিত্র্য কতটা বিস্তৃত ছিল।

তিনি বলেন, ‘ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশনকে সাধারণত জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে ধরা হয়, যখন অধিকাংশ প্রধান প্রাণী গোষ্ঠীর দেহ গঠনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে, সেই সময়েই বিবর্তন কী পরিমাণ দ্রুত ও বহুমুখী ছিল—তা এত দিন পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। মোসুরার আবিষ্কার প্রমাণ করে, আর্থ্রোপডদের এমন এক শাখা, যাদের এত দিন বিবর্তনের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় বলে মনে করা হতো, তারাও এই বিবর্তন “বিস্ফোরণ”-এর অংশ ছিল।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত