Ajker Patrika

বড় পরিবার ভেঙে এখন বহু পরিবার

বড় পরিবার ভেঙে এখন বহু পরিবার

আমাদের ছেলেবেলায় বোদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবার ছিল দত্ত পরিবার। এই দত্ত পরিবারের এক সদস্য আবার আমার বন্ধু। ফলে এই পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ও যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল সেই ছেলেবেলাতেই। 

দত্তবাড়ির অভিভাবক ছিলেন রাধিকা কিশোর দত্ত। ১০ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন দুটি। প্রথম পক্ষের ছয় পুত্র সন্তান। তাঁরা হলেন—হৃদয় কিশোর দত্ত (ডাক নাম ছিল ডালু), প্রফুল্ল কিশোর দত্ত, অনিল কিশোর দত্ত, সুকুমার দত্ত, শিবেন কিশোর দত্ত ও সনৎ কিশোর দত্ত। প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই ঘরে চার ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেদের নাম যথাক্রমে তারাপদ দত্ত (ডাক নাম মঙ্গল), বিজন বিহারী দত্ত (ডাক নাম বাবুল), শ্যামল কিশোর দত্ত ও অমল কিশোর দত্ত। মেয়েদের নাম অঞ্জলি, জ্যোৎস্না, মঞ্জু ও ইতি। ১৪ ছেলেমেয়ে নিয়ে বিরাট সংসার, বড় পরিবার। বাড়িটাও ছিল অনেক বড়। বিরাট ছিল বাড়ির চৌহদ্দি। 

দত্ত পরিবারের বিজন বিহারী আমার বন্ধু। একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকেই বিজন আমার বন্ধু নয়। ও ছোট থাকতে ওর দাদার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে চলে গিয়েছিল। তাই ওর শিক্ষাজীবন শুরু হয় আশ্রমে। পরে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বোদা প্রাইমারি স্কুলে এসে ভর্তি হয় এবং বলা যায় একেবারে প্রথম দিন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব পাকাপাকি হয়ে যায়। তার আগে অবশ্য সামান্য ভূমিকা আছে। চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে বিজন ছুটি কাটাতে বোদা এসেছিল। কিন্তু ছুটি শেষে ও আর আশ্রমে ফিরে যেতে চায় না। জোর করে পাঠানোর চেষ্টা করা হলে বিজনের সে কি চিৎকার করে কান্না! টেনেহিঁচড়েও ওকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নেওয়া যায়নি। আমাদের বাসা ছিল কাছাকাছি। আমার প্রয়াত বন্ধু ইউসুফ মন্টুর বাসায় আমরা তখন ভাড়া থাকতাম। ওই বাসার সামনে দিয়েই রাস্তা। বিজনকে যখন জোর করে বাসে ওঠানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ওর কান্না শুনে আমরা আশপাশে যারা ওর সমবয়সী ছিলাম, তারা সঙ্গ নিলাম। আমাদের সঙ্গে ওর আগে থেকেই আলাপ-পরিচয় ছিল। আমাদের দেখে বিজনের কান্নার বেগ বেড়ে গিয়েছিল। ওকে জোর করে আশ্রমে না পাঠানোর জন্য আমরা খুদে বাহিনী জোর সুপারিশ করেছিলাম। বিজন বোদায় থেকে গেল। বিজনের আশ্রমে যাওয়ার কারণ ওর দাদা সুকুমার দত্ত। তিনি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই সংসারত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে বলতাম সাধু দাদা। 

বিজনের বাবা, আমাদের জ্যাঠা মশাই, রাধিকা কিশোর দত্ত ছিলেন আপাদমস্তক একজন নির্বিরোধ ভালো মানুষ। তিনি কখনো কারও সঙ্গে কোনো ঝুটঝামেলায় জড়িয়েছেন বলে শোনা যায়নি। নিজের জায়গাজমির তদারকি ও সন্তানদের সময় দেওয়া ছাড়া তাঁকে আর কিছু করতে দেখেছি বলে মনে হয় না। তবে জায়গাজমি নিয়ে কেউ কোনো সমস্যায় পড়ে তাঁর কাছে এলে তিনি সৎ পরামর্শ দিতেন। জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তিনি ভালো বুঝতেন। তিনি সেকালের ‘মাইনর’ পাস ছিলেন। তিনি এবং সিরাজউদ্দিন আহমেদ একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। দুজনে ভালো বন্ধু ছিলেন। জমিজমার কাগজপত্র বিষয়ে দুজনেরই যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। সিরাজ সরকার সাহেব ‘দেউনিয়াগিরি’ করতেন, রাধিকা বাবু দেউনিয়া হিসেবে ততটা খ্যাতি পাননি। দেউনিয়াগিরি হলো আসলে মাতব্বরি। 

আগের দিনের মানুষ কতগুলো মূল্যবোধ মেনে চলতেন। নিজের সন্তানকে যেমন স্নেহ করতেন, সন্তানের বন্ধুদেরও একই চোখে দেখতেন। বিজনের বাবা এবং মায়ের কাছে বিজন, আর আমি আলাদা ছিলাম না। বিজনের দাদাদের কাছেও আমি ছোট ভাই-ই ছিলাম। 

বিজনের বাবা রাধিকা জ্যেঠামশাই একজন পরোপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি হাড় ভাঙার ভালো চিকিৎসা জানতেন। কারও হাত-পা ভেঙে বা মচকে গেলে তিনি তেল মালিশ করে ভালো করে তুলতেন। এক ধরনের ফিজিওথেরাপি। অনেকেই তাঁর ব্যবস্থাপনায় উপকার পেয়েছে। কিন্তু এই সেবাদানের বিনিময়ে তিনি কারও কাছে কোনো পয়সা নিতেন না। কেউ সেধে দিতে গেলেও রাগ করতেন। 

বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও তিনি ভেতরে-ভেতরে একটু রাগী মানুষই হয়তো ছিলেন। তবে সে রাগের প্রকাশ কখনো ঘটত না। তিনি বৈলাঅলা খড়ম পায়ে পরতেন। সে সময় বাড়িতে খড়ম পরারই নিয়ম ছিল। কেউ পরতেন ফিতাঅলা খড়ম। একটু বয়স্করা বৈলাঅলা খড়ম। তো, পুত্রসন্তানরা কখনো অবাধ্য হলে ওই খড়ম দিয়েই তাদের শায়েস্তা করতেন জ্যেঠামশাই। বিজনের পিঠেও দু-চার ঘা পড়েছে। 

আমরা পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। এখনকার মতো তখন তো আর কোচিং বাণিজ্য ছিল না। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন শৈলেন কুমার মোদক। ভীষণ রাগী। একটু এদিক-ওদিক হলেই আর রক্ষে ছিল না। তাঁর হাতে মার খায়নি—এমন ছাত্র পাওয়া যাবে না। আমি ছিলাম ব্যতিক্রম। আমাকে পিটুনি দেওয়ার কোনো উপলক্ষ স্যার পাননি। একবার এক উপলক্ষ তিনি তৈরি করেছিলেন, প্রয়োগ করার সুযোগ আমি তাঁকে দিইনি। ছাত্র খুব একটা খারাপ ছিলাম না। শৈলেন স্যার মনে করলেন, তিনি একটু গাইড করলে বৃত্তি পাওয়া সহজ হবে। তিনি আমাকে আর বিজনকে প্রতি সন্ধ্যায় দত্তবাড়িতে গিয়ে পড়ানো শুরু করলেন, কোনো টাকাপয়সা না নিয়ে। শুধু রাতের খাবার খেতে হলো জ্যেঠিমার হাতে। জ্যেঠিমা তাদের বড় ঘরের মেঝেতে কী যত্নে যে পিঁড়ি পেতে বসতে দিয়ে আমাদের সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করতেন! সব শেষে ঘন জ্বালের এক বাটি দুধ, যার ওপরে ভাসত পুরু সর। আমার আবার ছিল দুধ-ভাতে ভীষণ লোভ। আমি যতটা না পড়ার আগ্রহে ও বাড়ি যেতাম, তার চেয়ে বেশি যেতাম দুধের বাটির লোভে। 

লোভের কথায় আরেকটি বিষয় মনে পড়ল। একবার আমার খ্রিষ্টান হওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল। আমার তখন ধারণা ছিল খ্রিষ্টান হলে বুঝি মিশনারিরা বিদেশ নিয়ে যাবে। বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই খ্রিষ্টান হওয়ার আগ্রহ। দিনাজপুর মিশনে গিয়ে খ্রিষ্টান হওয়া যাবে বলে কারও কাছে হয়তো শুনেছিলাম। আমি বিজনকে পটালাম। ওকে পটানো সহজ কাজ ছিল না। ও আশ্রমে ছিল, দাদা ‘সাধু’। ও নিজেও একটু ‘ধার্মিক’ টাইপের ছিল (এখনো আছে। আমি ওকে সে জন্য গোসাই বলি)। তাই হিন্দুত্ব বাদ দিতে ও রাজি হচ্ছিল না। আবার আমাকে অখুশি করতেও চাচ্ছিল না। যা হোক, মূলত আমার চাপাচাপিতেই বিজন আমার সঙ্গে দিনাজপুর যেতে রাজি হলো। একদিন ভোরে আমরা বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে খ্রিষ্টান হওয়ার জন্য পালালাম। তখন দিনাজপুর যেতেও অনেক সময় লাগত। আমরা দিনাজপুর পৌঁছে গেলাম খ্রিষ্টান মিশনে। একজন ফাদার এসে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। কিছু হয়তো খেতেও দিয়েছিলেন। জানতে চাইলেন আমাদের মিশনে যাওয়ার উদ্দেশ্য। আমি অকপটে বলি, খ্রিষ্টান হতে চাই। তিনি আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া দুই কিশোরের নির্দোষ চোখমুখ দেখে ফাদার আর কতটুকু কি অনুমান করতে পারলেন, জানি না। বললেন, কেন তোমরা খ্রিষ্টান হতে চাও? 

আমি চটপট জবাব দিই, বিদেশ যাওয়ার জন্য। জবাব শুনে পাদ্রি বাবা খুশি হলেন বলে মনে হলো না। তিনি একটু গম্ভীর মুখে বললেন, বালক তোমার ভেতর লোভ ঢুকেছে। তুমি প্রভু যিশুর প্রতি ভালোবাসা থেকে খ্রিষ্টান হতে চাও না। বিদেশ যাওয়ার লোভে খ্রিষ্টান হতে চাও। 

যাক, আমার আর খ্রিষ্টান হওয়া হলো না। সে রাতটা দিনাজপুরে বিজনের দাদার বাসায় কাটিয়ে পরদিন বাড়ি ফিরে আসি। বিজনের দাদা-প্রফুল্ল কিশোর দত্ত পড়াশোনার জন্য দিনাজপুরে গিয়ে ওখানেই স্থায়ী হয়েছিলেন। খ্রিষ্টান হতে না গেলে তাঁর সঙ্গে হয়তো পরিচয়ও হতো না। প্রফুল্লদাও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওই এক রাত থেকেই বুঝেছিলাম, তিনি কতটা সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন। মনে আছে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল কারও ডাকাডাকিতে। হারিকেনের মৃদু আলোতে দেখলাম, বৌদি দাদাকে ঠেলছেন আর বলছেন, ‘অ্যাই ওঠো না গো।’ দাদা ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই জানতে চান, ‘কেন, কী হয়েছে?’ বৌদি বলেন, ‘তেষ্টা পেয়েছে। এক গ্লাস জল গড়িয়ে দাও।’ 

দাদা ধড়ফড় করে উঠলেন এবং কলসি থেকে গ্লাসে জল ঢেলে বৌদিকে দিলেন। তৃষ্ণা নিবারণ করে বৌদি আবার শুয়ে পড়লেন। স্ত্রীরাই শুধু স্বামীর সেবা করে না, স্বামীরাও স্ত্রী সেবা করে—প্রফুল্লদার কাছ থেকে সেই বালকবেলায় সেটা শিখেছিলাম। 

দত্তবাড়ির ১০ পুত্র সন্তানের মধ্যে বেঁচে আছেন পাঁচজন। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন পাঁচজন। সবচেয়ে যে ছোট, সেই অমলের অকাল বিদায় সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, ব্যথিত করেছে। অমন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছেলেটা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হলো। বিএ পাস করে সোনালী ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিল। ২৪-২৫ বছরের টগবগে যুবক, বন্ধুবৎসল, সদালাপী অমলকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। 

হৃদয়দা, প্রফুল্লদা, সনৎদা পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। কিন্তু তারাপদদার বিদায়টাও কিছুটা অকালেই হয়েছে। বোনদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট, সে-ই চলে গেছে সবার আগে। ওর নাম ছিল ইতি। নামটা রাখার পেছনেও বুঝি বিশেষ তাৎপর্য ছিল। ১৪ সন্তানের শেষ জন। তাই কি ইতি? বাবা-মা হয়তো আর সন্তান কামনা করেননি! ইতি আমাদের ছোট বোনের মতোই ছিল। ওর বিয়ে হলো বোদারই সুনীল কর্মকারের সঙ্গে। সুনীল আবার সম্পর্কে আমার মামা। বয়সে আমার ছোট। আমার ছোট কাকার নাম ছিল সুনীল সরকার। সে জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণে ঠিক মনে নেই, আমার ছোট কাকিমা সুনীল কর্মকারের মাকে ‘মা’ ডাকতেন। এভাবে দুই পরিবারের মধ্য আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে যায়। এভাবে ইতি আমার মামি। ওকে আমি মামি বললে রাগ করত। কারণ, আমি তো ছিলাম ওর দাদা। সুনীল এবং ইতি মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ইহলোক ত্যাগ করে। 

বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অঞ্জলিদির বিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রামে। তাঁর ছোট জ্যোৎস্নাদির দিনাজপুরে বিয়ে হলেও এখন তারা ভারতে চলে গেছেন। তার পরের বোন মঞ্জু সম্ভবত এখন বোদায়ই আছে। 

দত্তবাড়ির অন্তত চার সদস্য ভালো অভিনয় করতেন। একসময় বোদা ছিল সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বেশ অগ্রসর। গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদির প্রতি অনেকেরই অনুরাগ ছিল। প্রতিবছর এক বা একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। দত্তবাড়ির শিবেনদা, সনৎদা এবং তারাপদদা অভিনয় করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁদের পিসতুতো দাদা দয়াল চন্দ্র ঘোষও ভালো অভিনয় করতেন। তিনি দত্তবাড়ির চৌহদ্দিতেই বসবাস করতেন। 

সে সময় পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। সনৎদা এবং তারাপদদা নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। নায়িকা হিসেবে তারাপদদাকে মানাতোও ভালো। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, নারী চরিত্রে অভিনয় করে বোদার আরও দুজন খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তাঁদের একজন বোদা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল আলম সাবুলের বাবা আব্দুল চাচা এবং আরেকজন আমার পিসতুতো দাদা কার্তিক সরকার। এরা দুজনই প্রয়াত। 

নাটকের এই ধারাটা আমরাও অব্যাহত রেখেছিলাম। ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু করে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমরা বন্ধুরাও প্রতিবছরই নাটক করতাম। ক্লাস এইটে উঠে তো আমাদের নাটকের ভূতে পেয়েছিল। সে বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। হুলুস্থুল কাণ্ড আর কি! অভিভাবক এবং শিক্ষকদের শাসানি ছাড়াও ছাত্র আন্দোলনে বেশি জড়িয়ে পড়ায় নাটক থেকে আমরা দূরে সরে আসি। 

আমরা অবশ্য নারী চরিত্র বর্জিত নাটকই করতাম। একটু কম নাটকীয়তা থাকলেও আমাদের আনন্দে কোনো ঘাটতি থাকত না। 

দত্তবাড়ির অনিল দত্ত, শিবেন দত্ত, বিজন এবং শ্যামল, যার যার মতো করে জীবন ও সংসার নিয়ে আছেন। সুকুমার দত্ত, অর্থাৎ স্বামী পরদেবানন্দজির কথা আগে বলেছি। তিনি এখন ঢাকায় শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে আছেন। তিনি ‘তীর্থের পথে পথে’ নামে দুই খণ্ডের বড় দুটি বইও লিখেছেন। 

শিবেনদা একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। এখন সম্ভবত ‘ধর্মকর্ম’ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। 

বিজনের সুবাদে ও বাড়ির সবাইকে দাদা বললেও অনিল বাবুর বেলায় ব্যতিক্রম। তাঁকে কখনো দাদা বলেছি কি-না, মনে করতে পারছি না। আমার বাবার নাম অনিল। দুই অনিল ছিলেন আবার বন্ধুস্থানীয়। তাই আমি দত্তবাড়ির অনিল বাবুকে দাদা-কাকা কিছু না বলে ‘ভাবে সপ্তমী’ চালিয়ে দিতাম। দত্ত পরিবার এখন ভেঙে অনেক পরিবার হয়েছে। বাড়িগুলো প্রায় এক চৌহদ্দিতেই আছে। 

বিজনের সঙ্গে যোগাযোগটা এখনো অটুট আছে। আমাদের দুজনের আগ্রহেই এটা হয়েছে। 

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ত্রিভুজ সম্পর্কের অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায়

মাসুদ কামাল
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংকট কাটেনি। ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংকট কাটেনি। ছবি: সংগৃহীত

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।

গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।

মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।

জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।

তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!

সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?

এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।

এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শহীদ নূর হোসেন দিবস

গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে

নূর হোসেনের পিঠে লেখা ছিল এই স্লোগান। ছবি: সংগৃহীত
নূর হোসেনের পিঠে লেখা ছিল এই স্লোগান। ছবি: সংগৃহীত

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।

বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।

কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।

কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সম্ভাবনার জটিল পথ

মামুনুর রশীদ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।

বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।

আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।

এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?

বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।

আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।

মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নদীপাড়ের মাটি লুট

সম্পাদকীয়
নদীপাড়ের মাটি লুট

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।

সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।

নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।

নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।

অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত