Ajker Patrika

কাশ্মীরে হামলা: ভারত কী করবে

এম আর রহমান
জঙ্গিদের এবং তাদের মদদকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে ভারত। ছবি: এএফপি
জঙ্গিদের এবং তাদের মদদকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে ভারত। ছবি: এএফপি

কোনো মানুষ নিজের চোখে স্বর্গ দেখেছেন—এমন দাবি কেউ কখনো করেনি। পুরোটাই কল্পনায়। কিন্তু স্বর্গ যে অতীব মনোরম, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই হয়তো হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। কাশ্মীরে যাঁরা গেছেন, তাঁরা এর সৌন্দর্যে মোহিত হননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কাশ্মীরের মধ্যে আবার পেহেলগামের কদর আলাদা। অনেকে একে আদর করে বলেন প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।

সেই প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে কিনা ২২ এপ্রিল জঙ্গিরা হত্যা করল ২৬-২৭ জন মানুষকে। তা-ও ধর্মীয় পরিচয় জিজ্ঞাসা করে এবং নিশ্চিত হয়ে। একজন বাদে এরা সবাই হিন্দুধর্মাবলম্বী। এদের মধ্যে একজনের বাড়ি আবার নেপালে। তাহলে এই ঘাতকদের রাগটা কার ওপর? ভারতীয় হিন্দুদের ওপর, না শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর? কিন্তু এদেরই বাঁচাতে তো জঙ্গিদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে গিয়েছিলেন ঘোড়াচালক শহীদ সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। এদের মধ্যে কেউ হয়তো তাঁর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বৈসরন নামে এই এলাকায় এসেছিলেন। আদিলকেও ছাড়েনি জঙ্গিরা। তাঁর ‘হটকারিতা’ ক্ষমার অযোগ্য মনে করে সেখানেই শেষ করে দিয়েছে।

২৯ বছর বয়সী আদিল। বাড়িতে বাবা, মা, স্ত্রী ও পাঁচ ভাইবোন রয়েছেন। পর্যটকদের ভরসায় চলে জীবন। আর পর্যটকেরা—কেউ হামলার ছয় দিন আগে বিয়ে করে ভূস্বর্গে গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমা যাপনে। সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষ কী জবাব দেবে ওই অকাল বৈধব্যের শিকার মেয়েটিকে? সরকারি সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচ, কোন পাল্লায় কে বেশি ওজনদার—তা কি বোঝে মেয়েটি? আর বুঝলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্যতম অংশগ্রহণ আছে? নেই। নিহত-আহত, তাঁদের পাশে থাকা স্বজন কারোরই নেই। এ এক অদ্ভুত সার্কাস। মাস্টারের অঙ্গুলি হেলনে আমরা সবাই নাচতে থাকব, কিন্তু অদৃশ্য মাস্টার কখনো শনাক্ত হবে না।

জঙ্গিদের গুলিতে মারা যাওয়ার আগে অনেকেই দেড়-দুই ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ হেলিকপ্টার ছাড়া সম্ভব ছিল না। এরই মধ্যে স্থানীয় মুসলমান ঘোড়াচালকেরা কাঁধে-পিঠে করে তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন। এই সময়কালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। সরকারি উদ্ধার তৎপরতা আরও দ্রুত করলে হয়তো কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারতেন—এমনটাই দাবি তাঁদের স্বজনদের। তাঁদের হারানোর বেদনার মধ্যে যুক্তির অকাট্যতা খুঁজতে যাওয়া বোকামি। কিন্তু তা ফেলে দেওয়ারও নয়।

২০১৯ সালে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ের ওপর জঙ্গি হামলা এবং ৪৫ জন জওয়ানের মৃত্যুর পর কাশ্মীরে এত বড় ঘটনা ঘটল। বৈসরনের ঘটনা প্রমাণ করল, কাশ্মীর নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৯ সাল থেকে যে যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার মধ্যে বজ্র আঁটুনির গেরোটা ফসকাই থেকে গেছে। একটা অদ্ভুত বিষয় হলো, ২২ এপ্রিল যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন। ফলে এই জঘন্য ঘটনার শোক ও ক্ষোভ দেশব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। ভারতের সব জায়গার মানুষ এই ঘটনায় প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের দাবিতে এক কাতারে।

এই ঘটনা নিয়ে ভারতের শাসক দলের একাংশ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলার চেষ্টা করেছিলেন। তার সঙ্গে ছিল মোদি-প্রিয় গোদি মিডিয়া। তবে তাদের সেই চেষ্টা খুব একটা কলকে পায়নি। কারণ আদিলের আত্মত্যাগ, স্থানীয় ঘোড়াচালকদের উদ্ধার তৎপরতা, সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ঝন্টু শেখ নামে এক বাঙালি মুসলমান সৈনিকের শহীদ হওয়া—এই ঘটনায় সমালোচনামুখর না হয়ে সব রাজনৈতিক দল মোদি সরকারের পাশে এসে দাঁড়ায়, সর্বোপরি কাশ্মীরজুড়ে হয়েছে বৈসরনের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ। কাশ্মীরের প্রতিবাদ ছিল অভূতপূর্ব। যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত চোখ রাখেন তাঁরা জানেন, পেহেলগামের এক প্রত্যন্ত বাজারে কীভাবে স্থানীয় মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। সেখান থেকে একজন তা সরাসরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁদের অবস্থান।

ফলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিতে বিশ্বাসীরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি ভারতে। যদিও ভারত সরকার তাৎক্ষণিক অনেক ব্যবস্থা নেয়। এর মধ্যে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওই দেশ ত্যাগ করতে বলা হয়। সব পাকিস্তানি নাগরিকের ভারতীয় ভিসা বাতিলের সমন চলে যায়। দিল্লিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় পাকিস্তান দূতাবাসের সামরিক কূটনীতিকদের। বাতিল করা হয় ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি। এ সবই দেশের মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রমাণ।

পাল্টা একাধিক ব্যবস্থা পাকিস্তানও নিয়েছে। এর মধ্যে আছে সিমলা চুক্তি বাতিল, পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারতীয় উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য বন্ধ করা ইত্যাদি। দুই দেশের এমন যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে এই উপমহাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে এই আশঙ্কা তীব্র হয়েছে যে দুই পরমাণু অস্ত্রধর দেশ সত্যিই বোধ হয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। অতীত ও বর্তমান বলছে, যুদ্ধ হয়তো হবে না, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষতির পরিমাণ কম হবে না। যে ঘৃণার বীজ সেই ১৯৪৭-এর আগে থেকে রোপিত হয়েছে, তা জলসিঞ্চনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মহিরুহ হওয়ার পথে।

ভারত সরকারের দিক থেকে একটা তাগিদ আছে, বৈসরনের ঘটনায় পাল্টা কিছু করে দেখানোর। বিহারের এক নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘বিহারের মাটিতে দাঁড়িয়ে গোটা পৃথিবীকে বলতে চাই, ভারত জঙ্গিদের এবং তাদের মদদকারীদের ও ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে। বিশ্বের শেষ প্রান্তে গিয়ে আমরা তাদের খুঁজে বের করব। তারা এমন শাস্তি পাবে, যা তাদের কল্পনারও অতীত।’ হিন্দিতে দেওয়া ভাষণের মধ্যে এই কথাগুলো তিনি ইংরেজিতে বলেছেন। তাহলে কি মোদি এই কথার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছেন? কী সেই ইঙ্গিত?

পাকিস্তানও বসে নেই। দেশটির সেনাপ্রধান ও রাজনীতিকেরা ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা তোপ দেগেই চলেছেন। কেউ বলছেন, সিন্ধুর পানি আটকানোর চেষ্টা করলে ক্ষেপণাস্ত্র মেরে তা ধ্বংস করব। আবার কেউ সিন্ধু দিয়ে পানি না প্রবাহিত হলে ভারতীয়দের রক্ত বয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছেন। জনতুষ্টিবাদী এসব বক্তব্যের অসারতা প্রমাণের জন্য কোনো পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। কারণ ভারতীয় বিশেষজ্ঞ অভিষেক দে ইন্ডিয়া টুডেতে লিখেছেন, ভারতের সিদ্ধান্ত চুক্তি স্থগিত করা মানেই পাকিস্তানে পানি প্রবাহ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা নয়। এর কারণ, বর্তমানে ভারতের কাছে এমন অবকাঠামো নেই, যা সিন্ধু নদের পানি পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হওয়া বন্ধ করতে পারে কিংবা তা নিজের উদ্দেশে সরিয়ে নিতে পারে। সর্বোচ্চ যা সম্ভব, তা হলো ৫-১০ শতাংশ পানি কমানো।

পাকিস্তানের তখতে এখন শাহবাজ শরিফ। কিন্তু পেছনে আছেন বড় ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। শোনা যাচ্ছে, নওয়াজ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে ছোট ভাইকে পরামর্শ দিয়েছেন, ভারতের উত্তেজনা তৈরির ফাঁদে পা না দিতে। বরং কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যস্থতার সহায়তা নেওয়া। নওয়াজ শরিফ পোড়খাওয়া ও বাস্তববাদী রাজনীতিক। তাই দেশের পরিস্থিতি বুঝে যথার্থ পরামর্শ দিয়েছেন।

ভারতের ব্যাপারেও একই পরামর্শ খাটে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা তারা কানে তুলবে কি না বলা কঠিন। না তুললে দুই দেশের অপ্রত্যক্ষ সংঘাত অব্যাহত থাকবে। আর প্রাণ যাবে উলুখাগড়ার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত