মযহারুল ইসলাম বাবলা
আমাদের পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত স্বার্থরক্ষার উপায় নেই। যেহেতু বিদ্যমান ব্যবস্থাটি হচ্ছে শ্রম-শোষণের এবং শ্রমিক-নিগ্রহের উর্বর ক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষা কিংবা সুরক্ষার উপায় নেই। শ্রমিকমাত্রই শ্রমবাজারে শ্রম বিনিয়োগ করবেন এবং বিনিময়ে পাবেন মজুরি। প্রাপ্ত মজুরিতে শ্রমিকের চাহিদা পূরণ হবে কি হবে না, সে বিবেচনা নেই মালিকের, নেই রাষ্ট্রের ও সরকারের। অথচ শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া মুনাফা লুটে নেয় শ্রম-শোষক চক্র। হরেক প্রকার মুনাফানির্ভর পণ্যের মতো আমাদের দেশে শ্রমিকও মুনাফানির্ভর পণ্যে পরিণত। শ্রম বেচে শ্রমিক কেবলই মজুরি পাবেন—এর বেশি কিছু নয়। স্বীকার করছি একজন শ্রমিকের তুলনায় একজন শিল্পমালিক অধিক পরিশ্রম করেন; সেটা কায়িক-মানসিক উভয় ক্ষেত্রে। কিন্তু শিল্পমালিক তাই বলে শ্রমজীবী নন। তাঁর শ্রমের সঙ্গে মজুরির সম্পর্ক নেই। রয়েছে মুনাফার সম্পর্ক। মজুরি সীমিত কিন্তু মুনাফা অঢেল এবং লাগামহীন। বণিক পুঁজির লুণ্ঠনকারী। সেই পুঁজির ফাঁদে আটকা পড়েছেন শ্রমিক। পুঁজি বিনিয়োগে শিল্প-কারখানা পুঁজিওয়ালারা গড়লেও শ্রমিক ব্যতিরেকে পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। উৎপাদনব্যবস্থায় শ্রমিক অপরিহার্য এবং প্রধান উপাদান। শ্রমিককে কেবল মজুরি প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মুনাফার অংশীদারত্ব শ্রমিকের নেই। পুরো মুনাফা ভোগ করে পুঁজির লগ্নিকারকেরা।
মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা এবং সামন্ত যুগের অবসানের পর বুর্জোয়া ব্যবস্থায় শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণের স্বাধীনতা এসেছে। তিনি কোথায় শ্রম বেচবেন, এই অধিকার তিনি পেয়েছেন। ইচ্ছানুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নিতে পারছেন। যেটা আগে ভাবাও যেত না। দাস যুগ-সামন্ত যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের উত্তরণে শ্রমিকের কিছু স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সত্য, কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থায় উৎপাদনসংশ্লিষ্ট শ্রমিকের উৎপাদনের বিনিময়ে অর্জিত মুনাফার অংশীদারত্ব পাওয়ার কোনো উপায় নেই। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক কেবল শ্রম বেচেন না। উৎপাদিত পণ্যের অংশীদারত্বের অধিকারও থাকে। রাষ্ট্রই তার আবাস, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানের শিক্ষা অর্থাৎ সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করে।
আমরা যে চা খাই, সেই চায়ের মূল উৎপাদনকারী দেশ চীন। এখন চীনের চা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতবর্ষের বেশ কিছু অঞ্চলে চায়ের আবাদ শুরু হয়। সেসব চা-বাগানের সিংহভাগ মালিকানা ছিল ইংরেজদের। চা-বাগানের শ্রমিকের মতো অমানুষিক পরিশ্রম ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চলের মানুষের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। দক্ষিণ ভারতের তামিল-তেলুগু জাতির শ্রমিকেরা এই পেশায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত শ্রীলঙ্কায় রাবার এবং চা-বাগানের শ্রমিকরূপে তামিলদের স্বয়ং ইংরেজরা সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতির আগমন ঘটেনি। অতীতের ব্রিটিশ শাসনামলের ধারাবাহিকতায় আজও দেশের প্রতিটি চা-বাগানের শ্রমিক বস্তির পাশে শুঁড়িখানার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। দিনমান অমানুষিক পরিশ্রমের পর শ্রমিকদের মদ্যপানের নেশায় চেতনা বিনাশের ব্যবস্থাটি ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকেরা চাতুর্যে চালু করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, শ্রমিকের সেই চেতনানাশক শুঁড়িখানা আজও প্রতিটি চা-বাগানের শ্রমিকদের বস্তি সংলগ্নে দেখা যায়। শ্রম শোষণে নানা ফন্দি আঁটা হয়ে থাকে। শ্রমিকেরা যাতে অসন্তোষে দ্রোহী হয়ে উঠতে না পারেন, সেই কারণে শ্রমিকের চেতনানাশের অভিনব পন্থাটি আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে।
শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষের মজুরিসংক্রান্ত টানাপোড়েনে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মালিক-শ্রমিকের শ্রেণি সমস্যা নিরসনে তাদের ভূমিকা শূন্য। শ্রম শোষণের ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রেখেই মালিক এবং শ্রমিকের মজুরিসংক্রান্ত নানা বিতর্ক অবসানে ট্রেড ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করে থাকে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে বিপ্লবের ভাবনা যাঁরা ভাবতেন, তাঁদের উদ্দেশে লেনিন অত্যন্ত দৃঢ়তায় উপহাস করেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন বিপ্লবী আদর্শ-অঙ্গীকারে ব্রত কোনো সংগঠন নয়। শ্রেফ শ্রমিকের মজুরির দর-কষাকষির মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ। শ্রমিকের অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের অতিরিক্ত কিছু করণীয় তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের মজুরিসচেতন করে সত্য; তবে শ্রেণিসচেতনতায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। মালিক-শ্রমিকের বিদ্যমান বিভাজন অক্ষুণ্ন রেখে ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড সীমিত। সে কারণে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা শ্রমিক সংগঠনগুলো দূতালিরূপে কাজ করে মাত্র। দেশের প্রেক্ষাপটে শ্রমিকনেতারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত। আমাদের শ্রমিকনেতারা যতটুকু শ্রমিকের অনুকূলে, তার চেয়ে অধিক স্বীয় রাজনৈতিক দলের আনুগত্যে অনুগত থাকেন। আমাদের শ্রমিকদের উন্নতি না হলেও শ্রমিকনেতাদের অভাবনীয় উন্নতি কিন্তু আমাদের নজর এড়াতে পারেনি। শ্রমিকনেতাদের সংসদ সদস্য-মন্ত্রিত্ব লাভ নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব বৈধ-অবৈধ সরকারের শাসনামলে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরূপে আমরা তাঁদের দেখে এসেছি।
বিশ্বের সভ্যতা, উন্নয়ন, উৎপাদন, অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক বিকাশে শ্রমিকশ্রেণির অবদান অপরিসীম। অথচ তাঁরা বরাবরই উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূলে প্রবাসী শ্রমিকশ্রেণির এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবদানের কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রবাসী এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রাপ্য মূল্যায়ন-স্বীকৃতি, রাষ্ট্র-সরকার দেয় কি? দেয় না। বরং রাষ্ট্র এবং সরকারগুলোর বিপরীত অবস্থান আমরা দেখে থাকি। বিদেশে যাঁরা যান তাঁরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে নয়, একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জমি বেচে, ধারদেনা করে বহু কষ্টে বিদেশে পাড়ি দেন। তাঁদের স্বার্থরক্ষায় একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। যার নাম প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর কল্যাণে মন্ত্রণালয়টি যথার্থ ভূমিকা পালন করেছে, তেমন নজির কিন্তু নেই। গার্মেন্টস সেক্টরে বকেয়া মজুরি, উৎসব-ভাতাসংক্রান্ত শ্রমিকদের নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তা নিরসনে কোনো সরকারই শ্রমিকের স্বার্থে ভূমিকা রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। বিপরীতে মালিকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে, এমনকি শ্রমিক ঠেঙাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয়।
গার্মেন্টসে নানা দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের মৃত্যুর পরও একজন গার্মেন্টস মালিকের বিচার ও শাস্তি এ পর্যন্ত হয়নি। রাষ্ট্র এবং সরকারগুলো শ্রমিকের পক্ষে অতীতেও ছিল না, আজও নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্ত-ঘামের বিপরীতে রাষ্ট্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা তো পরের কথা, রাষ্ট্র তাঁদের জীবন রক্ষার নিরাপত্তা পর্যন্ত দিতে পারেনি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের পদদলিত হয়ে, আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে হত্যার ঘটনা দেশে ঘটেছে। অথচ রাষ্ট্র এবং সরকার এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নির্লিপ্ত। দুর্ঘটনা নামক ফাঁদে কত শত শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন, তা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। সাভারের রানা প্লাজায় কত হাজার শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন, তারও সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। শ্রম শোষণ এবং শ্রমিক হত্যার এমন অমানবিক দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। এমন অমানবিক রাষ্ট্র বিশ্বে দ্বিতীয়টি নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যে গরু দুধ দেয়, সে গরুর দেখভালে গোয়ালাদের অধিক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। অথচ যে শ্রমিকের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং মালিকদের মুনাফার পাহাড় গড়ে ওঠে, সেই শ্রমিকদের হত্যাকাণ্ডে এই রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিকেরা অনিবার্যভাবে শ্রমিক হত্যাকারী। অগণিত শ্রমিক হত্যার বিচার না হলে এর ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে না। ক্রমেই আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে। তাই সর্বাগ্রে দেশবাসী শ্রমিক হত্যায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে এসেছে। সভ্যতা-মানবতার এরূপ স্খলনে বিশ্ব বিবেক নড়ে ওঠে অথচ আমাদের রাষ্ট্র-সরকার এবং শ্রম শোষকেরা মৃত শ্রমিকের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দায়িত্ব শেষ করে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে প্রচুর শিল্পকারখানা মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রচুর কলকারখানা। মব ভায়োলেন্সে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে অগণিত শ্রমিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছেন। অথচ রাষ্ট্র ও সরকার বেকারে পরিণত হওয়া অগণিত শ্রমিকের বিষয়ে নির্বিকার।
বিদ্যমান ব্যবস্থাধীনে এ ধরনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমাদের হতেই থাকবে। তাই অতি আবশ্যিক ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার কোনো উপায় নেই। সম্ভব হবে কেবল বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে এবং সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরে। আর এক দিন বাদেই পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিবসটি আসা-যাওয়া করছে বছরের পর বছর। কিন্তু শ্রমিকের জন্য আশাবাদী বার্তা নিয়ে আসে না। মে দিবসকে কেন্দ্র করে শাসকশ্রেণির উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা ও বাণী প্রচার-প্রচারণা আমরা দেখে আসছি। কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় শাসকশ্রেণি কোনো ভূমিকা এ পর্যন্ত পালন করেনি। শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ এই ব্যবস্থাধীনে সম্ভব নয়। তবে আগামী দিনে কি হবে না? তা-ইবা বলি কীভাবে? ইতিহাসের শিক্ষা তো তা বলে না।
আমাদের পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত স্বার্থরক্ষার উপায় নেই। যেহেতু বিদ্যমান ব্যবস্থাটি হচ্ছে শ্রম-শোষণের এবং শ্রমিক-নিগ্রহের উর্বর ক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষা কিংবা সুরক্ষার উপায় নেই। শ্রমিকমাত্রই শ্রমবাজারে শ্রম বিনিয়োগ করবেন এবং বিনিময়ে পাবেন মজুরি। প্রাপ্ত মজুরিতে শ্রমিকের চাহিদা পূরণ হবে কি হবে না, সে বিবেচনা নেই মালিকের, নেই রাষ্ট্রের ও সরকারের। অথচ শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া মুনাফা লুটে নেয় শ্রম-শোষক চক্র। হরেক প্রকার মুনাফানির্ভর পণ্যের মতো আমাদের দেশে শ্রমিকও মুনাফানির্ভর পণ্যে পরিণত। শ্রম বেচে শ্রমিক কেবলই মজুরি পাবেন—এর বেশি কিছু নয়। স্বীকার করছি একজন শ্রমিকের তুলনায় একজন শিল্পমালিক অধিক পরিশ্রম করেন; সেটা কায়িক-মানসিক উভয় ক্ষেত্রে। কিন্তু শিল্পমালিক তাই বলে শ্রমজীবী নন। তাঁর শ্রমের সঙ্গে মজুরির সম্পর্ক নেই। রয়েছে মুনাফার সম্পর্ক। মজুরি সীমিত কিন্তু মুনাফা অঢেল এবং লাগামহীন। বণিক পুঁজির লুণ্ঠনকারী। সেই পুঁজির ফাঁদে আটকা পড়েছেন শ্রমিক। পুঁজি বিনিয়োগে শিল্প-কারখানা পুঁজিওয়ালারা গড়লেও শ্রমিক ব্যতিরেকে পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। উৎপাদনব্যবস্থায় শ্রমিক অপরিহার্য এবং প্রধান উপাদান। শ্রমিককে কেবল মজুরি প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মুনাফার অংশীদারত্ব শ্রমিকের নেই। পুরো মুনাফা ভোগ করে পুঁজির লগ্নিকারকেরা।
মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা এবং সামন্ত যুগের অবসানের পর বুর্জোয়া ব্যবস্থায় শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণের স্বাধীনতা এসেছে। তিনি কোথায় শ্রম বেচবেন, এই অধিকার তিনি পেয়েছেন। ইচ্ছানুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নিতে পারছেন। যেটা আগে ভাবাও যেত না। দাস যুগ-সামন্ত যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের উত্তরণে শ্রমিকের কিছু স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সত্য, কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থায় উৎপাদনসংশ্লিষ্ট শ্রমিকের উৎপাদনের বিনিময়ে অর্জিত মুনাফার অংশীদারত্ব পাওয়ার কোনো উপায় নেই। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক কেবল শ্রম বেচেন না। উৎপাদিত পণ্যের অংশীদারত্বের অধিকারও থাকে। রাষ্ট্রই তার আবাস, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানের শিক্ষা অর্থাৎ সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করে।
আমরা যে চা খাই, সেই চায়ের মূল উৎপাদনকারী দেশ চীন। এখন চীনের চা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতবর্ষের বেশ কিছু অঞ্চলে চায়ের আবাদ শুরু হয়। সেসব চা-বাগানের সিংহভাগ মালিকানা ছিল ইংরেজদের। চা-বাগানের শ্রমিকের মতো অমানুষিক পরিশ্রম ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চলের মানুষের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। দক্ষিণ ভারতের তামিল-তেলুগু জাতির শ্রমিকেরা এই পেশায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত শ্রীলঙ্কায় রাবার এবং চা-বাগানের শ্রমিকরূপে তামিলদের স্বয়ং ইংরেজরা সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতির আগমন ঘটেনি। অতীতের ব্রিটিশ শাসনামলের ধারাবাহিকতায় আজও দেশের প্রতিটি চা-বাগানের শ্রমিক বস্তির পাশে শুঁড়িখানার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। দিনমান অমানুষিক পরিশ্রমের পর শ্রমিকদের মদ্যপানের নেশায় চেতনা বিনাশের ব্যবস্থাটি ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকেরা চাতুর্যে চালু করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, শ্রমিকের সেই চেতনানাশক শুঁড়িখানা আজও প্রতিটি চা-বাগানের শ্রমিকদের বস্তি সংলগ্নে দেখা যায়। শ্রম শোষণে নানা ফন্দি আঁটা হয়ে থাকে। শ্রমিকেরা যাতে অসন্তোষে দ্রোহী হয়ে উঠতে না পারেন, সেই কারণে শ্রমিকের চেতনানাশের অভিনব পন্থাটি আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে।
শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষের মজুরিসংক্রান্ত টানাপোড়েনে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মালিক-শ্রমিকের শ্রেণি সমস্যা নিরসনে তাদের ভূমিকা শূন্য। শ্রম শোষণের ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রেখেই মালিক এবং শ্রমিকের মজুরিসংক্রান্ত নানা বিতর্ক অবসানে ট্রেড ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করে থাকে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে বিপ্লবের ভাবনা যাঁরা ভাবতেন, তাঁদের উদ্দেশে লেনিন অত্যন্ত দৃঢ়তায় উপহাস করেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন বিপ্লবী আদর্শ-অঙ্গীকারে ব্রত কোনো সংগঠন নয়। শ্রেফ শ্রমিকের মজুরির দর-কষাকষির মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ। শ্রমিকের অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের অতিরিক্ত কিছু করণীয় তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের মজুরিসচেতন করে সত্য; তবে শ্রেণিসচেতনতায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। মালিক-শ্রমিকের বিদ্যমান বিভাজন অক্ষুণ্ন রেখে ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড সীমিত। সে কারণে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা শ্রমিক সংগঠনগুলো দূতালিরূপে কাজ করে মাত্র। দেশের প্রেক্ষাপটে শ্রমিকনেতারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত। আমাদের শ্রমিকনেতারা যতটুকু শ্রমিকের অনুকূলে, তার চেয়ে অধিক স্বীয় রাজনৈতিক দলের আনুগত্যে অনুগত থাকেন। আমাদের শ্রমিকদের উন্নতি না হলেও শ্রমিকনেতাদের অভাবনীয় উন্নতি কিন্তু আমাদের নজর এড়াতে পারেনি। শ্রমিকনেতাদের সংসদ সদস্য-মন্ত্রিত্ব লাভ নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব বৈধ-অবৈধ সরকারের শাসনামলে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরূপে আমরা তাঁদের দেখে এসেছি।
বিশ্বের সভ্যতা, উন্নয়ন, উৎপাদন, অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক বিকাশে শ্রমিকশ্রেণির অবদান অপরিসীম। অথচ তাঁরা বরাবরই উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূলে প্রবাসী শ্রমিকশ্রেণির এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবদানের কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রবাসী এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রাপ্য মূল্যায়ন-স্বীকৃতি, রাষ্ট্র-সরকার দেয় কি? দেয় না। বরং রাষ্ট্র এবং সরকারগুলোর বিপরীত অবস্থান আমরা দেখে থাকি। বিদেশে যাঁরা যান তাঁরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে নয়, একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জমি বেচে, ধারদেনা করে বহু কষ্টে বিদেশে পাড়ি দেন। তাঁদের স্বার্থরক্ষায় একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। যার নাম প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর কল্যাণে মন্ত্রণালয়টি যথার্থ ভূমিকা পালন করেছে, তেমন নজির কিন্তু নেই। গার্মেন্টস সেক্টরে বকেয়া মজুরি, উৎসব-ভাতাসংক্রান্ত শ্রমিকদের নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তা নিরসনে কোনো সরকারই শ্রমিকের স্বার্থে ভূমিকা রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। বিপরীতে মালিকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে, এমনকি শ্রমিক ঠেঙাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয়।
গার্মেন্টসে নানা দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের মৃত্যুর পরও একজন গার্মেন্টস মালিকের বিচার ও শাস্তি এ পর্যন্ত হয়নি। রাষ্ট্র এবং সরকারগুলো শ্রমিকের পক্ষে অতীতেও ছিল না, আজও নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্ত-ঘামের বিপরীতে রাষ্ট্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা তো পরের কথা, রাষ্ট্র তাঁদের জীবন রক্ষার নিরাপত্তা পর্যন্ত দিতে পারেনি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের পদদলিত হয়ে, আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে হত্যার ঘটনা দেশে ঘটেছে। অথচ রাষ্ট্র এবং সরকার এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নির্লিপ্ত। দুর্ঘটনা নামক ফাঁদে কত শত শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন, তা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। সাভারের রানা প্লাজায় কত হাজার শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন, তারও সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। শ্রম শোষণ এবং শ্রমিক হত্যার এমন অমানবিক দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। এমন অমানবিক রাষ্ট্র বিশ্বে দ্বিতীয়টি নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যে গরু দুধ দেয়, সে গরুর দেখভালে গোয়ালাদের অধিক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। অথচ যে শ্রমিকের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং মালিকদের মুনাফার পাহাড় গড়ে ওঠে, সেই শ্রমিকদের হত্যাকাণ্ডে এই রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিকেরা অনিবার্যভাবে শ্রমিক হত্যাকারী। অগণিত শ্রমিক হত্যার বিচার না হলে এর ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে না। ক্রমেই আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে। তাই সর্বাগ্রে দেশবাসী শ্রমিক হত্যায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে এসেছে। সভ্যতা-মানবতার এরূপ স্খলনে বিশ্ব বিবেক নড়ে ওঠে অথচ আমাদের রাষ্ট্র-সরকার এবং শ্রম শোষকেরা মৃত শ্রমিকের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দায়িত্ব শেষ করে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে প্রচুর শিল্পকারখানা মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রচুর কলকারখানা। মব ভায়োলেন্সে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে অগণিত শ্রমিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছেন। অথচ রাষ্ট্র ও সরকার বেকারে পরিণত হওয়া অগণিত শ্রমিকের বিষয়ে নির্বিকার।
বিদ্যমান ব্যবস্থাধীনে এ ধরনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমাদের হতেই থাকবে। তাই অতি আবশ্যিক ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার কোনো উপায় নেই। সম্ভব হবে কেবল বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে এবং সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরে। আর এক দিন বাদেই পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিবসটি আসা-যাওয়া করছে বছরের পর বছর। কিন্তু শ্রমিকের জন্য আশাবাদী বার্তা নিয়ে আসে না। মে দিবসকে কেন্দ্র করে শাসকশ্রেণির উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা ও বাণী প্রচার-প্রচারণা আমরা দেখে আসছি। কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় শাসকশ্রেণি কোনো ভূমিকা এ পর্যন্ত পালন করেনি। শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ এই ব্যবস্থাধীনে সম্ভব নয়। তবে আগামী দিনে কি হবে না? তা-ইবা বলি কীভাবে? ইতিহাসের শিক্ষা তো তা বলে না।
নেদারল্যান্ডসের নাগরিক পিটার ভ্যান উইঙ্গারডেন ও মিনকে ভ্যান উইঙ্গারডেন। তাঁরা ২০১২ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে বিজনেস ট্রিপে গিয়েছিলেন। সেখানে হারিকেন স্যান্ডির মুখোমুখি হন। হারিকেন স্যান্ডি ম্যানহাটানকে প্লাবিত করে। সেখানকার বাসিন্দাদের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। ঝড়ের কারণে
৬ ঘণ্টা আগেদিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। মানসিক বিড়ম্বনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ধারণাটা হয়তো এ রকম যে, মরতে যখন হবেই তখন আজই কী আর কালইবা কী! স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা যখন নেই, তখন অস্বাভাবিক মৃত্যু যেকোনো সময় হতেই পারে। তবে মৃত্যুর প্রস্তুতিটা সহজ নয়; বেশ কঠিন।
৬ ঘণ্টা আগেসাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও ইছামতী নদী থেকে চিংড়ির পোনা সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। নদী থেকে এভাবে পোনা মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু তাদের দৈনিক আয় সামান্য হলেও বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তারা এ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। মৎস্য কর্মকর্তারা বিকল্প জীবিকার কথা বলে
৬ ঘণ্টা আগেরাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় এখন যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তার অনেকগুলোই রাজনীতিকেন্দ্রিক। তবে সব কথা অকুণ্ঠচিত্তে মানুষ বলে না। বোঝা যায়, একধরনের সেলফ সেন্সরশিপও আছে। ‘দেয়ালেরও কান আছে’—এ রকম যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
১ দিন আগে