Ajker Patrika

সন্জীদা খাতুন একটি দীপ্ত আলোর নাম

চঞ্চল খান
সন্জীদা খাতুন
সন্জীদা খাতুন

সংগীত যাঁর ধ্যান, সাহিত্য যাঁর প্রাণ, আর দেশপ্রেম যাঁর জীবনদর্শন—তিনি সন্জীদা খাতুন। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই একধরনের আলো ছড়িয়ে পড়ে, যেটি জাতিসত্তা, চেতনাবোধ আর মননের প্রসারের আলো। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত সুর, তাঁর জীবনচর্চা, তাঁর মনন ও প্রজ্ঞা—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক চরিত্র।

সন্‌জীদা খাতুন—সর্বজনীন আপা ছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের বাতিঘর, যিনি নিজের আলোয় পথ দেখিয়েছেন বহু মানুষকে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের অনন্য ব্যাখ্যায়িত্রী, ছিলেন শিক্ষক, লেখক, সংগঠক, চেতনার কান্ডারি। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন এক নির্ভীক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। যিনি গানকে অস্ত্র করেছেন, যিনি সংগীতের সুরে স্বাধীনতার দীপ্ত বার্তা ছড়িয়েছেন।

১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল, এক মধুর বসন্ত দিনে জন্ম তাঁর। পিতা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জ্ঞানতাপস, ভাষাবিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ ও শিক্ষানুরাগী। সেই শিক্ষার বাতাবরণে বেড়ে ওঠা সন্‌জীদা খাতুনের চিরসাথি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংগীত। তাঁর শৈশব কেটেছে বইয়ের পাতায়, সুরের প্রবাহে, আর বাঙালিত্বের নীরব শিখায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক, পরে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা করেছেন ইডেন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তিনি শুধু পাঠদান করেননি, বরং অনুপ্রেরণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে জাগিয়ে তুলেছেন সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস, আর সহকর্মীদের কাছে ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক।

ষাটের দশকে যখন পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির সংস্কৃতি দমনের পাঁয়তারা করে, তখনই জন্ম নেয় ছায়ানট। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়ে, রাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে, গানকে সামনে রেখেই শুরু হয়েছিল এই সংগঠনের পথচলা। সেই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কলিম শরাফী প্রমুখ। ছায়ানট ছিল শুধু একটি সংগঠন নয়, ছিল প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁরা তখন দেখিয়েছিলেন, কীভাবে সংস্কৃতি হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদ।

রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের সূর্যবরণ অনুষ্ঠান, আজ যা একটি জাতীয় ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে, তার পেছনেও ছিল সন্জীদা আপার গভীর ভাবনা। তিনি বুঝেছিলেন, সংস্কৃতিকে গণমানুষের জীবনের অংশ না করলে জাতিসত্তা শক্ত হতে পারে না। গান, আবৃত্তি, পাঞ্জাবি-শাড়ি, বাঙালিয়ানা—এসবের মধ্য দিয়েই তিনি নির্মাণ করেছেন এক সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের বলয়। এই বলয় নতুন প্রজন্মের মধ্যে আত্মমর্যাদা, সৌন্দর্যবোধ ও মানবিকতার চর্চা ছড়িয়ে দেয়। ছায়ানট তাঁর কাছে শুধু প্রতিষ্ঠান ছিল না, ছিল এক চলমান আন্দোলন।

ছায়ানটের সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক, সংগঠক, এমনকি শিক্ষার্থী—অনেকে ছিলেন তাঁরই স্নেহছায়ায় গড়ে ওঠা। তাঁর ক্লাসে শৃঙ্খলা যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রশ্রয় এবং স্নেহ।

তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘গান শুধু সুর নয়, গান হলো আত্মার আহ্বান।’ সেই আহ্বানেই তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট পথ ধরে আজও চার হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে ছায়ানটে। যাদের শেখানো হচ্ছে, কীভাবে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়, কীভাবে নিজের শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা যায়।

তাঁর ভাবনায় শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তা ছিল একই সূত্রে বাঁধা। তাঁর কাছে সংস্কৃতি ছিল না কখনো বিলাসিতা, বরং একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার অবলম্বন। তিনি মনে করতেন, যত দিন না একটি জাতি তার সংস্কৃতিকে ভালোবাসবে, যত দিন না সেই সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজের পরিচয়কে দৃঢ় করবে, তত দিন সে জাতির উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি বারবার বলতেন—‘মানুষ হও, মানুষ হও আবার তোরা মানুষ হও’—এই ছিল তাঁর জীবনের মন্ত্র।

তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ছিল এক নীরব প্রতিজ্ঞা—দেশকে ভালোবাসার, মানবতাকে ধারণ করার এবং নতুন প্রজন্মকে আলোর পথে চালিত করার। এমন মানুষ যুগে যুগে জন্মান না। তিনি ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস, যিনি নিজের জীবন দিয়ে গড়েছেন একটি জাতির সাংস্কৃতিক চরিত্র।

আজ তিনি নেই, কিন্তু প্রতিটি বসন্ত সকালে রমনার বটমূলে যখন ‘ওই মহাশূন্যে’ ধ্বনিত হয়, তখন আমরা জানি সন্জীদা খাতুন আছেন, ঠিক আমাদের মাঝখানেই, সুর হয়ে, আলো হয়ে, চেতনার নীরব ধ্বনি হয়ে। তাঁর জীবনের পাঠ আমাদের শিখিযে যায়: গান শুধু গান নয়, গান এক শক্তি, যা জাতির আত্মাকে জাগিয়ে তোলে।

তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন ৯৩ বছর বয়সে। আমি আজ চারপাশে তাকাই, আর খুঁজি—আরেকজন সন্জীদা খাতুন কোথায়, যিনি গান শেখাবেন অনুভবের আলোয়, বিনোদনের বাইরে, তা যেন হয় ধ্যান, মননের শক্তি, আর আনন্দের উৎস। আমি কাউকে দেখি না তাঁর মতো আর দেখার সম্ভাবনাও দেখি না আমার জীবদ্দশায়।

লেখক: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত