Ajker Patrika

খই ফোটা

রাজীব কুমার সাহা
খই ফোটা

বাংলা ভাষায় একটি অতি পরিচিত শব্দ হলো খই। কারও কারও মুখের ভাষায় আবার ‘খই ফোটে’। এতে কেউ হয় মুগ্ধ আবার এটি অতিরঞ্জিত হলে কেউ হয় বিরক্ত। কারও আবার কথায় তুবড়ি ছোটে, কারওবা ফুলঝুরি। পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে কেউবা প্রবচন হিসেবে বলে থাকেন ‘নেই কাজ তো খই ভাজ।’ কথাচ্ছলে খই ভাজার কাজটিকে কিছুটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলেও আদতে কাজটি মোটেও হেলাফেলার নয়। ধান থেকে বালুতে খই ভাজা এবং ভাজার পরে তা থেকে ধানের খোসা পৃথক করা সত্যিই কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু খই ফোটার বিশেষত্ব কী? শব্দবন্ধটি তার আক্ষরিক অর্থ ছেড়ে কীভাবে আলংকারিক অর্থে পরিগ্রহ করেছে জানব তার ইতিবৃত্ত। তবে চলুন দই-খই-গুড় একত্রে মেখে ‘খই ফোটা’র আলোচনার নৈবেদ্য সাজাই।

খই এবং ফোটা শব্দ সহযোগে খই ফোটা শব্দবন্ধটি বিশিষ্টার্থক বাগধারা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। আক্ষরিকভাবে খই ফোটা শব্দের অর্থ হলো, খই তৈরির বিশেষ ধান তপ্ত বালুর কড়াইয়ে কাঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করে পটপট শব্দে খই ফুটে বেরোতে থাকা। আর এর আলংকারিক অর্থ হলো ধান ভাজার সময় খই ফোটার মতো মুখ থেকে অনর্গল কথা নিঃসৃত হওয়া।

খই হলো খোলায় ধান ভেজে তৈরি খাদ্যবস্তুবিশেষ। এর প্রতিশব্দ হলো খদি, খদিকা, লাজ প্রভৃতি। মূলত খই প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াটি থেকেই খই ফোটা বাগধারাটি গঠিত হয়েছে। শুরুতে একটি মাটির খোলা বা পাত্রে বালু গরম করা হয়। এরপর খই তৈরির বিশেষ জাতের ধানকে তপ্ত বালুভর্তি কড়াইয়ে ঝাড়ুসদৃশ কাঠির (সচরাচর নারকেল পাতার শলাকায় তৈরি) গুচ্ছ দিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করলে তা অবিরাম শব্দে পাত্রের ভেতরে ফুটতে থাকে। ধান থেকে সাদা রঙের খই পটপট শব্দে ফুটে বাইরে পড়তে থাকে। হাঁড়ির ধানগুলো একবার সশব্দে ফোটা শুরু করলে তা বিরামহীন চলতে থাকে। সত্যিই সে এক দেখার মতো দৃশ্য! এমনভাবেই কারও মুখের কথাও অনর্গল বা একটানা চলতে থাকলে তখন বলা হয়, তার মুখে যেন খই ফুটছে।

খই ভাজার ক্ষেত্রে তাপমাত্রাই মুখ্য বিষয়। খই ফোটার জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খই ভাজার ধানে প্রায় ১০-১৫ শতাংশ পানি থাকে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি বাষ্প হয়ে বীজগুলোর ভেতরে উচ্চচাপ সৃষ্টি করে। ভেতরের এই বাষ্পের চাপ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেলে বাইরের আবরণ ফেটে যায়। ধানটি উচ্চতাপে রান্না হওয়ার কারণে ভেতরের শর্করার অণুগুলো প্রসারিত ও নরম হয়ে খইয়ের বাইরের সাদা আবরণ সৃষ্টি করে। এ সময়ে উচ্চ চাপে এর ভেতরের উপাদান বেরিয়ে আসে, যা পাত্রে ধাক্কা দেওয়ার ফলে মনে হয় খইগুলো দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে।

একসময় বাংলার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তো বটেই, উচ্চবিত্তদের পরিবারেও সকালে খই-দুধ বা খই-দই খাওয়ার চল ছিল। বাঙালিদের প্রাতরাশে খই খাওয়ার চলও বেশ পুরোনো। চিড়া-গুড়-খই মেখে সুস্বাদু জলখাবারও খাওয়া হতো বাঙালি পরিবারে। এমনকি খইকে পূজা-পার্বণের অন্যতম উপকরণ হিসেবেও রাখা হতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে অগ্নিসাক্ষী করে খই পোড়ানোর চল রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে খই খাওয়ার সুবিধা এই ছিল যে, এটি যেমন সহজে পাওয়া যায়, তেমনি সহজে খাওয়াও যায় এবং খাবার হিসেবেও বেশ হালকা। এক কথায় সহজপাচ্য খাবার।

গবেষণায় খইয়ের গুণমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, খইয়ে রয়েছে শরীরের জন্য জরুরি বিবিধ বায়ো-অ্যাক্টিভ যা ক্যানসার, হৃদরোগ এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমিয়ে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহযোগিতা করে। খইয়ে আয়রনও আছে, যা ভাতের থেকেও পরিমাণে অনেক বেশি। গবেষকদের মতে, ধান বালুতে ভেজে খই বানানোর প্রক্রিয়ায় আয়রন অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক প্রভৃতি খনিজও রয়েছে খইয়ে। প্রতি এক শ গ্রাম খইয়ে দশ গ্রামের মতো প্রোটিন থাকে। খইয়ে আছে প্রয়োজনীয় ফাইবার যা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী। সবচেয়ে বড় কথা, খই খাবার হিসেবে নিরাপদ এবং সহজপাচ্য। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিতভাবে মুখে খই না ফুটিয়ে চলুন নিয়মিত খই খেতে অভ্যস্ত হই। আর ভবিষ্যতে কেউ ‘খই ভাজা’ নিয়ে ব্যঙ্গ করলে তাকে খই খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলি।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা

আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত