Ajker Patrika

উন্নয়নের পথে চীন বরাবরই বাংলাদেশের আস্থাশীল অংশীদার

জাং শিওইয়ু (বৃষ্টি)
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৫: ১৬
উন্নয়নের পথে চীন বরাবরই বাংলাদেশের আস্থাশীল অংশীদার

গত জুলাইতে বাংলাদেশে প্রথম বড় আকারের আধুনিক স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (পয়ঃশোধনাগার) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা ওয়াসার অধীনে ‘দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার’ প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড়। এই শোধনাগারে দিনে ৫০ লাখ টন পয়ঃশোধন করবে, যা রাজধানী ঢাকার মোট পরিশোধনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নত হয়ে উঠবে।

দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পটির নির্মাণকাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়। চীনা কোম্পানি এই প্রকল্পের ডিজাইন ও নির্মাণ শেষে প্রকল্পটি এক বছরের কার্যক্রম ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করে। প্ল্যান্টটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। গত বছর ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা আংশিকভাবে সমাধান করা হয়েছে এবং দাসেরকান্দির পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ কাঠামোর অধীনে দ্বিপক্ষীয় প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ প্রমাণ করে, বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা দুই দেশের জনগণের জন্য ব্যাপকভাবে কল্যাণকর। এ বছর চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ দশম বার্ষিকী এবং বাংলাদেশ ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’ যোগদানের সপ্তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত উন্নত হয়েছে এবং ২০১৬ সালে দুদেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

চীন ও বাংলাদেশের নেতারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। গত ১০ বছরে দুই দেশের নেতারা বহুবার সফর বিনিময় করেছেন। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরকে ‘ল্যান্ডমার্ক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারত্বে উন্নীত করা হয়েছে বলে সেই সফরে দুই দেশের নেতারা যৌথ ঘোষণা দেন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ২০১৬ সালে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ এবং দুই দেশের মধ্যে আদান-প্রদান ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রবেশ করে।

‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ কাঠামোর অধীনে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা গভীরভাবে বিকশিত হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে কর্মী বিনিময়ের মাত্রা প্রসারিত হতে চলেছে। এখন বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ও কর্মরত চীনাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ছুঁয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৯ সালে চীন সফর করেন। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বেইজিংস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে চীনপ্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর উপলক্ষে এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে। বেইজিংয়ে আয়োজিত সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থী যারা চীনে লেখাপড়া করছে, তাদের আমি বলব, এই দেশের কাছ থেকে তারা অনেক কিছুই শিখতে পারে, কী করে চীনের জনগণ দিনরাত এত পরিশ্রম করে।’ তিনি বাংলাদেশি যুবকদের চীনে অধ্যয়ন করতে উৎসাহিত করেন, বাংলাদেশি পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ ও বিনিময় সফরের জন্য চীনে যেতে, চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে এবং সোনার বাংলা গড়তে অবদান রাখতে বলেন। 

চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শক্ত ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে নয়া চীন সফর করেন। তিনি চীনে যা দেখেছেন এবং শুনেছেন এবং চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ডায়েরি ২০২০ সালে ‘আমার দেখা নয়া চীন’ নামে বই হিসাবে সংকলিত এবং প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের প্রকাশনা চীন-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রচনা করেছে। বইটিতে তিনি চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের দৃশ্যটি স্নেহের সঙ্গে স্মরণ করেছেন, একই  সময়ে সামাজিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক নির্মাণে নয়া চীনের অর্জনগুলোও লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি নিজের দেশকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য চীনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে আগ্রহী ছিলেন।

চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বে উচ্চশিক্ষা সব সময়ই দুই দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে আরও গভীর করার সহায়ক। চীনের বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা চীন-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছে। এ বছর চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা স্নাতক প্রোগ্রামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ৬০তম বার্ষিকী পালিত হয়। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে চীন আটজন তরুণ ছাত্রকে প্রথমবারের মতো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য পাঠায়। তাঁরা তাঁদের পড়াশোনা শেষ করে চীনে ফিরে আসার পর, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ১৯৬৩ সালে বেইজিংয়ে ব্রডকাস্টিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমান কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না) প্রথম বাংলা কোর্স প্রতিষ্ঠা করেন। স্নাতকদের আরেকটি অংশ চীনা বাংলা সম্প্রচার এবং বাংলা অধ্যয়নের অগ্রগামী ও প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠেন। সেই থেকে বাংলা শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রচার চীনে শিকড় গেঁড়েছে এবং প্রতিভার দল ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বর্তমানে চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ স্থাপন করেছে। প্রতিবছর শতাধিক শিক্ষার্থী এসব বিভাগে ভর্তি হন। তাঁদের মধ্য থেকে অনেকে শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রাম ও অধ্যয়নের জন্য বাংলাদেশে যায়।

অন্য অনেক চীনা পণ্ডিত বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের মতো বিষয়ে একাডেমিক গবেষণা পরিচালনা করেছেন এবং অনেক বই প্রকাশ করেছেন। চীনের মিডিয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্মাণ ও সামাজিক উন্নয়নের গল্পে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে এবং চীনারা অতীতের চেয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে এখন বেশি জানে। চীনা টিভি নাটক, চলচ্চিত্র এবং টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশিরাও চীন সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানতে পারছে।

চীন ও বাংলাদেশ ১৯৭৬ সাল থেকে শিক্ষার্থী বিনিময় করছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে চীন। চীনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবছর ১০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীন সরকারের বৃত্তি পান। আজ তরুণ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীনা ভাষা এবং চীনা সংস্কৃতি শেখার জন্য উৎসাহী। তাঁরা চীনে অধ্যয়ন করতে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, হাইটেক এবং অন্যান্য মেজর পড়তে আগ্রহী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি চীনা বিভাগ স্থাপনকারী প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৫ সালে একটি চীনা গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চীনা ভাষা শেখার এবং চীনা অধ্যয়ন পরিচালনার জন্য একটি একাডেমিক উচ্চভূমিতে পরিণত হয়েছে। একই সময়ে চীন বাংলাদেশের নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে যথাক্রমে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং কনফুসিয়াস ক্লাসরুম স্থাপন করেছে। এ দুটি চীনা ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সমৃদ্ধ শিক্ষা ও বিনিময় প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছে।

বর্তমানে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ইঞ্জিনিয়ারিং চুক্তির বাজার। চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশ, দুই দেশেরই সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ দুটি দেশের মধ্যে উইন-উইন সহযোগিতার সুযোগ প্রদান করেছে। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আকার এবং বাজারের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে, দুই দেশের সহযোগিতার জন্য বিস্তৃত স্থান রয়েছে। বাংলাদেশ এখন দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনীতি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একটি উন্নয়নের তারকা হয়ে উঠেছে। ইতিহাস ও অনুশীলন প্রমাণ করেছে যে, উন্নয়নের মহাসড়কে চীন সব সময় বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল অংশীদার হবে। 

লেখক: 
স্কলার, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ
কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না, বেইজিং, চীন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ না করার প্রস্তাব

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত