Ajker Patrika

উদ্বেগ-আশ্বাসের দোলাচলে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি

ডয়চে ভেলে
আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৪: ৩৬
উদ্বেগ-আশ্বাসের দোলাচলে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি

চার দিন পর শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। কিন্তু এবার পূজা শুরুর বেশ আগে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বেশ কিছু ঘটনায় নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদ্‌যাপন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

দুর্গাপূজার প্রস্তুতি ঘিরেও ঘটেছে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা; পূজামণ্ডপ বা প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে৷ তাই, উৎসবের তেমন স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাচ্ছে না। পূজা নির্বিঘ্ন করতে সরকার উদ্যোগের আশ্বাস দিলেও ভরসা পাচ্ছেন না সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তার ওপর কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যাও পূজার আয়োজনকে ম্লান করেছে৷ সব মিলে উদ্বেগ-আশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে চলছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিগত সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারেরও পূজার নিরাপত্তা দেওয়ার একধরনের চেষ্টা আছে৷ আবার পূজা না করতে দেওয়ার হুমকিও আছে৷ এর মধ্যে গত ১৩ দিনে ১৩টি জেলায় ১৭টি মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূজা করা সম্ভব সেটা বোঝাই যায়৷ অনেক সার্বজনীন মণ্ডপে এবার শুধু ঘট পূজা হচ্ছে৷’

তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় দুজন ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ বলেন, ‘এখন শুধু থানার ওসিকে বদলানোতেই তো দুর্বৃত্তদের থামানো যাবে না৷ বরং তাদের গ্রেপ্তার না করায় তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷’

বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর নিরাপত্তার বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে৷ সরকারের সেই চেষ্টাও আমরা দেখছি৷ আমরা নিজেরাও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি৷’

এবার পূজায় স্বতঃস্ফূর্ততা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে৷ কেউ যদি মানসিকভাবে ভালো না থাকেন, তাহলে তো তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূজা করতে পারবেন না৷ আবার কেউ ভালো থাকলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করবেন৷ তবে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় আমাদের সবারই মন খারাপ৷ আসলে মন্দিরে হামলার বিচার না হওয়ায় এসব ঘটনা কমছে না৷’

যেসব স্থানে ভাঙচুরের ঘটনা

গত তিন দিনের মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের শ্রীশ্রী জিউর আখড়ায় দুর্গাপূজার সাতটি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷ বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম শ্যামপুর দেউরীবাড়ি সার্বজনীন দুর্গামন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷ এ ঘটনার পর বাকেরগঞ্জ থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ পাবনার সুজানগরে চার দিনের ব্যবধানে দুটি মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে৷ এতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷ এ ঘটনার পর সুজানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাকিউল আজমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ কিন্তু এসব ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি৷

যারা প্রতিমা ভাঙচুর করছে তাদের কেন গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর জানান, তাঁরা দায়ীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "পূজার নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ আইজিপি প্রতিদিনই এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছেন৷ কোথাও কোনো ঘটনার খবর পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে ওসিদের প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ পাশাপাশি অপরাধীদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে৷’’

পূজামণ্ডপকেন্দ্রিক পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে এবং পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে দুর্গাপূজা ঘিরে আট দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷

কয়েক দিন আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় হরি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর হয়৷ সেখানে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায় সে ভারতীয় নাগরিক৷ যদিও পরে ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানে জানা যায় তিনি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের বাসিন্দা৷ এখন ওই মন্দিরের অবস্থা কী, কতটা নিরাপত্তা সেখানে নিশ্চিত হয়েছে জানতে চাইলে ভাঙ্গা বাজার হরি মন্দির কমিটির সভাপতি স্বপন সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গতকালও পুলিশের ডিআইজি আমাদের এখানে এসেছিলেন৷ তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন৷ আমরা নিজেরাও নিয়মিত পাহারা দিচ্ছি৷ এখন পর্যন্ত নতুন করে আর কোনো সংকট হয়নি৷ তার পরও সভাপতির মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়ে অন্যরা তো শঙ্কিত৷ তাঁদের মধ্যে একধরনের শঙ্কা আছে৷ আসলে যত কথাই বলেন, পূজা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই৷ একধরনের উৎকণ্ঠা আছে৷” 

পূজার প্রস্তুতি

মন্দির-মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা নির্মাণ, প্যান্ডেল-মঞ্চ স্থাপন, সাজসজ্জাসহ নানা ধরনের প্রস্তুতি চলছে৷ হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব ৯ অক্টোবর শুরু হয়ে চলবে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত৷ ২ অক্টোবর দুর্গাদেবীর আবাহন তথা মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দেবীর আরাধনা৷ এর এক সপ্তাহ পর ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা৷ সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার দোলায় (পালকি) চড়ে স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন; যার ফল হচ্ছে মড়ক৷ এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে৷ দেবী স্বর্গলোকে বিদায় (গমন) নেবেন গজে (হাতি) চড়ে; যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে৷

এবার বাংলাদেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা কিছুটা কমার কথা বলছে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ৷ যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এবার পূজা হচ্ছে ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে৷ গত বছর ৩২ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে পূজা হয়েছে৷ তাদের হিসাবে ঢাকায় গত বছর ২৫৩টি মণ্ডপে পূজা হলেও এবার হচ্ছে ২৬০টি মণ্ডপে৷

বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সারা দেশে এবার কত মণ্ডপে পূজা হচ্ছে, সেটা এখনো আমরা নিশ্চিত নই৷ দুই-এক দিনের মধ্যে পুরো তালিকা চলে আসবে৷ পুলিশ সদর দপ্তর আমাদের জানিয়েছে, ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে৷ তবে অনেক এলাকায় পূজার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না৷ যেমন বন্যদুর্গত এলাকাগুলোতে তো আর পূজার কোনো অবস্থাই নেই৷ সেই হিসাবে কিছু কমে যাবে৷ ফলে পুরো তালিকা পেতে আমাদের আরও দুই-এক দিন অপেক্ষা করতে হবে৷”

সাম্প্রতিক ঘটনায় অনেকে মণ্ডপেই পূজার আয়োজনে কাটছাঁট করছেন আয়োজকেরা৷  অনেকেই এবারের উৎসব কমিয়ে পূজাকে শুধু ঘট পূজায় নিয়ে গেছেন৷ 

রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পূজামণ্ডপ নিরাপত্তাজনিত কারণে এবার কুমারি পূজার আয়োজন না করার ঘোষণা দিয়েছিল৷ তবে শনিবার রাতে সেনা কর্মকর্তারা মঠ কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে কুমারি পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত জানায় রামকৃষ্ণ মিশন৷৷

আট দফা দাবি

এদিকে বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে আট দফা দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের নেতারা৷ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাজপথ ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন৷ গত শুক্রবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট আয়োজিত এক গণসমাবেশে এসব কথা বলেন জোটের নেতারা৷ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে এই জোট গঠিত৷ দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর, মন্দির, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট, দখল, হত্যা, ধর্ষণ, দেশত্যাগের হুমকি, মব জাস্টিসের নামে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যাচেষ্টাসহ সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধকরণপূর্বক প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ প্রদান, দোষীদের দ্রুতবিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণ এবং সরকারের কাছে পেশকৃত আট দফা বাস্তবায়নের দাবিতে এই গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়৷ গত ১৩ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আট দফা দাবি পেশ করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা৷

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য

এদিকে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ এবং সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়ে সঠিক বার্তা দেয় না বলে মন্তব্য করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ শুক্রবার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন৷ তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ভারত বারবার বাংলাদেশকে জানিয়েছে এবং বলেছে যে সেখানে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রয়োজন৷ এটা আমাদের প্রত্যাশা যে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত৷ দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলার বিষয়টি বাংলাদেশের আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা উচিত৷’

দিল্লির এমন মন্তব্যের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত৷

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত