Ajker Patrika

২০২১ সাল যাঁদের কেড়ে নিল

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ৪২
২০২১ সাল যাঁদের কেড়ে নিল

চলে যাওয়া বছরটিতে আমরা হারিয়েছি অনেক বরেণ্য ব্যক্তিকে। এর মধ্যে অভিশপ্ত কোভিডও কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ।

বছরের শুরুতেই ৩ জানুয়ারি আমরা হারিয়েছি একুশে পদকজয়ী লেখিকা রাবেয়া খাতুনকে। অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। কয়েকটি উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ‘মেঘের পর মেঘ’, ‘মধুমতী’র নাম বলা যেতে পারে। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বর্তমান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে জন্মেছিলেন তিনি। 

 এর পরের আঘাত আসে এ টি এম শামসুজ্জামানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের শক্তিমান এই অভিনেতাও পেয়েছিলেন একুশে পদক। ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমণি’, ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘গেরিলা’ তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের কয়েকটি। জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলায়। 

প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মুকসুদ চলে গেলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি। ভালো গবেষক ছিলেন তিনি। মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বই লিখেছেন। লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। তাঁর ভাষা ছিল সরল, কিন্তু গভীর তথ্যসমৃদ্ধ। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর তাঁর জন্ম হয়। 

মার্চ মাসও ছিল বিয়োগের বেদনায় ভরা। ৪ মার্চ মারা যান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। ১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম হওয়া এইচ টি ইমাম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব। একই মাসের ৮ তারিখ চলে যান বাংলাদেশি চলচ্চিত্র অভিনেতা শাহীন আলম। আর ১৬ মার্চ মারা যান বিএনপির নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে একজন সুলেখক হিসেবে পরিচিত মওদুদ আহমদের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৪ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। 

 এপ্রিলের এমনিতেই বদনাম ছিল, আছেও। ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট তো সেই কবেই এপ্রিলকে ‘নিষ্ঠুরতম মাস’ আখ্যা দিয়েছেন। সে কথা রাখতেই যেন এ বছরের এপ্রিল একের পর এক আঘাত হানল। এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ এসেছিল দুঃসংবাদ নিয়ে। এদিন লোকসংগীতশিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী মারা যান। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী। ১৯৪৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১০ এপ্রিল মারা যান সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান শাহরিয়ার। সুনামগঞ্জ জেলায় ১৯৪৬ সালের ২৫ এপ্রিল জন্ম হয়েছিল তাঁর। এর ঠিক পরদিনই চলে যান মিতা হক। 

 রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক মারা যান ১১ এপ্রিল। কিডনির রোগে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে ঢাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শিল্পী করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনাই তাঁকে একেবারে দুর্বল করে ফেলেছিল। এপ্রিলের বাতাসকে ভারী করে তোলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এতেও যেন সে নিজেকে ‘নিষ্ঠুরতম’ প্রমাণ করতে পারছিল না। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার আঘাত। এবার শামসুজ্জামান খান। ১৪ এপ্রিল বাংলা একাডেমির এই সাবেক মহাপরিচালক চলে যান। ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা এই অধ্যাপক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ছাপ রেখে গেছেন বহু লেখায়। এই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই চলে যান ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী। ১৭ এপ্রিল চলে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রশিল্পী কবরী। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মানো সারাহ বেগম কবরী ছিলেন এই বাংলার চলচ্চিত্রের একজন গুণী শিল্পী। শক্তিমান এই শিল্পীর ঝুলিতে আছে ‘সোয়ে নদিয়া জাগে পানি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘কাচ কাটা হীরে’, ‘সুজনসখী’, ‘সারেং বউ’-এর মতো ছবি। পাশাপাশি ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মন কাড়ে। রাজনীতিও করেছেন, করেছেন চলচ্চিত্র পরিচালনা। রাজ্জাক-কবরী জুটি একসময় চলচ্চিত্রের দর্শকদের মন জুড়িয়ে দিয়েছিল। 

 শামসুজ্জামান খানের মেয়াদ ফুরালে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব পেয়েছিলেন কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। কিন্তু বেশি দিন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না। ২৪ মে মারা যান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। ফরিদপুরে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’, ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’, ‘হাওয়া কলে জোড়াগাড়ি’, ‘নোনা জলে বুনো সংসার’, ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’, ‘আমার একজনই বন্ধু’, ‘পোশাক বদলের পালা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা’, ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ণ’, ‘জয় বাংলা বলো রে ভাই’, ‘সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না’ উল্লেখযোগ্য। 

মারা যান অর্থনীতিবিদ ও সমাজসেবক শাহ আব্দুল হান্নান। ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদীতে জন্ম নেওয়া এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর (বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৪ জুলাই মারা যান গীতিকার ও ছড়াকার ফজল-এ-খোদা। তাঁর লেখা গান ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’ খুবই জনপ্রিয়। তবে যে গানটি লিখে তিনি বাংলাদেশকে ঋণী করে গেছেন, সেটি হলো ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’। শিশুদের জন্য তাঁর লেখা ছড়াগুলো অনবদ্য। ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

 ২৩ জুলাই চলে যান গণসংগীতশিল্পী, শব্দসৈনিক ফকির আলমগীর। বাংলাদেশে পপসংগীতের পুরোধাব্যক্তিত্বদের একজন তিনি। আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই ও পিলু মমতাজকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই সময়ের তারুণ্যের গান। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে তিনি গণসংগীতে অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী। ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে’ গানটি তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এ ছাড়া ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম’, ‘নাম তার ছিল জন হেনরি’ গানগুলোর কথা মানুষ মনে রাখবে। ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

কথাসাহিত্যিক ও লেখক বুলবুল চৌধুরী মারা যান ২৮ আগস্ট। ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্ম নেওয়া নিভৃতচারী শক্তিমান এই সাহিত্যিক ২০১১ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। আর যে বছর পেলেন একুশে পদক, সে বছরই মারা গেলেন। 

অভিনেতা, লেখক, নাট্যকার ও শিক্ষক ইনামুল হক মারা যান ১১ অক্টোবর। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের এই পুরোধাব্যক্তিত্ব ছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও নাটকের জন্যই তিনি জনপ্রিয়তা পান। মঞ্চ, টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। 

 বছরের শেষ দিকে চলে যান প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। রাজশাহীতে নিজের বাসায় ১৫ নভেম্বর মারা যান তিনি। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই লেখকের লেখা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’, ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’, ‘সারা দুপুর’ ও ‘কেউ আসেনি’। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

মৃত্যুর এ সারিতে নাম লেখান একুশে পদকপ্রাপ্ত নজরুল গবেষক, বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। দিনটি ছিল ৩০ নভেম্বর। ভাষা আন্দোলনে তাঁর তোলা ছবিগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর রয়েছে অনেকগুলো গবেষণাগ্রন্থ। ভাষা আন্দোলন, কবি নজরুল ইসলাম, ভাষাতত্ত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। 

 ডিসেম্বরের ২০ তারিখে মারা যান একাত্তরের রণাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী। ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বই। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই শেষ নয়। বড়দিনের দিন চলে যান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। ২৫ ডিসেম্বর মারা যান একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক নেতা। 

সব মিলিয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশ একের পর এক কৃতিকে হারিয়েছে। হ্যাঁ, করোনায় সারা বছরই নানা শ্রেণি-পেশার নানা বয়সী মানুষ মারা গেছেন। এই প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তারপরও কিছু মৃত্যু থাকে, যা জাতীয় জীবনে একটা শূন্যতার সৃষ্টি করে। এ বছর বিভিন্ন অঙ্গনের এমন বহু মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, যাঁদের অভাব বোধ হবে অনেক দিন। যাঁদের এই হারিয়ে যাওয়ার কারণেও ২০২১ সালকে মানুষ মনে রাখবে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত