Ajker Patrika

কক্সবাজার রেলস্টেশন

২১৫ কোটির আইকনিক স্টেশনের পূর্ণ ব্যবহার নেই

  • ছয়তলা ভবনে হোটেল, ফুড কোর্ট, শোরুমসহ নানা সুবিধা পাচ্ছে না যাত্রীরা।
  • পূর্ণাঙ্গ চালু হলে মাসে ১০-১২ কোটি টাকা ইউটিলিটি খরচ হবে, জানিয়েছে রেলওয়ে।
  • তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্টেশন ভবনটি পরিচালনার পরিকল্পনা।
তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা 
ছয়তলাবিশিষ্ট কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন ভবনের প্রতিটি তলায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা। প্রায় দুই বছর হতে চললেও এখনো চালু হয়নি আধুনিক ভবনটি।	ছবি: আজকের পত্রিকা
ছয়তলাবিশিষ্ট কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন ভবনের প্রতিটি তলায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা। প্রায় দুই বছর হতে চললেও এখনো চালু হয়নি আধুনিক ভবনটি। ছবি: আজকের পত্রিকা

২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল করছে এই স্টেশন থেকে। এরপর প্রায় দুই বছর হতে চললেও এখনো চালু হয়নি স্টেশনের ছয়তলা আধুনিক ভবনটি। ফলে আইকনিক এই স্টেশনে থাকা হোটেল, ফুড কোর্ট, শোরুম, মাল্টিপারপাস হলসহ নানা সুবিধার কোনোটিই ব্যবহার করতে পারছে না যাত্রীরা। অনেকটাই অলস পড়ে আছে পুরো অবকাঠামো।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই স্টেশন পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে শুধু ইউটিলিটি খাতেই প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। এত ব্যয়ভার নিজেদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় বলে স্টেশনটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরিচালনা করার পরিকল্পনা নিয়েছে রেলওয়ে। কোন পদ্ধতিতে সেটি ইজারা বা পরিচালনার জন্য দেওয়া হবে, তার ডকুমেন্টস প্রস্তুতির কাজ চলছে। ইতিমধ্যে রেলওয়ে একটি খসড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়েছে। সবকিছু চূড়ান্ত হলে দরপত্র আহ্বান করা হবে। কিন্তু কবে নাগাদ দরপত্র আহ্বান করা হবে, তা অনিশ্চিত।

দেশে এ ধরনের নানা সুবিধা-সংবলিত বৃহৎ রেলস্টেশন পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমেই ইজারা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন হয়েছিল ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর। আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘পর্যটক’ ও ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ নামের দুটি ট্রেন চলাচল করছে। ট্রেন আসা এবং ছাড়ার সময় স্টেশনের নিচতলা খোলা হয়। ট্রেন চলে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যায় স্টেশন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন গত ২৯ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন প্রাইভেট অপারেটরকে দিয়ে পরিচালনা করা হবে। তার জন্য দরপত্র আহ্বানের কাজও শুরু হয়েছে। আশা করি, খুব শিগগির এটি পরিচালনার জন্য দরপত্র আহ্বান করতে পারব।’

কী আছে আইকনিক স্টেশনে?

কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনটি আধুনিক নকশার ছয়তলা ভবন। এটি বাইরে থেকে বিমানবন্দর বা পাঁচতারা হোটেলের মতো দেখায়। সমুদ্রসৈকত থেকে স্টেশনটির দূরত্ব মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার।

ছয়তলা স্টেশন ভবনটির প্রতিটি তলায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরের আয়তন ৪৬,০৭৩ বর্গফুট। এখানে রয়েছে তিনটি দোকানের জায়গা, এটিএম বুথ, ডাকঘর, লাগেজ ও লকার রাখার ব্যবস্থা এবং ফ্রেশ হওয়ার সুবিধা। রেলের ব্যবহারের জন্য রয়েছে টিকিট কাউন্টার ও সরকারি অফিসের বিভিন্ন সেবা।

প্রথম তলার আয়তন ৪২,০৭৭ বর্গফুট। এই ফ্লোরে রয়েছে ১৭টি দোকানের জায়গা ও একটি ফুড কোর্ট। এ ছাড়া রয়েছে ডিপারচার লাউঞ্জ, ওয়েটিং লাউঞ্জ, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন ডেস্ক, প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টার এবং প্রার্থনা রুম।

ভবনটির দ্বিতীয় তলা ৩৫,৩২৫ বর্গফুট আয়তনের। এখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ১৭টি দোকানের জায়গা ও পাঁচটি শোরুম। এ ছাড়া রয়েছে ফুড কোর্ট ও রেস্টুরেন্ট।

তৃতীয় তলার আয়তন ৪৩,০৬৬ বর্গফুট। মূলত হোটেল সুবিধার জন্য নির্ধারিত এ তলায় মোট ৩৯টি রুম রয়েছে, যার মধ্যে ২৫টি স্ট্যান্ডার্ড এবং ১৪টি ডিলাক্স। এ ছাড়া রয়েছে চারটি কমার্শিয়াল স্পেস, রেস্টুরেন্ট ও ডাইনিং এরিয়া।

চতুর্থ তলা ৩৫,৭৩৪ বর্গফুট আয়তনের। এখানে রয়েছে সাতটি অফিস স্পেস, একটি মাল্টিপারপাস হল এবং একটি রেস্টুরেন্ট। পঞ্চম তলা ৩৬,৫৯২ বর্গফুট আয়তনের, যা মাল্টিপারপাস ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিটি তলায় সিঁড়ি, এসকেলেটর, বেবি কেয়ার কর্নার, টয়লেট এবং ইনফরমেশন ডেস্ক রয়েছে। ভবনের বাইরেও প্রশাসনিক ভবনসহ আরও ১৭টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) এ প্রকল্পে কাজ করছে চীনের চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি), তমা কনস্ট্রাকশন, চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) এবং বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুই বছর কেটে গেলেও কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন চালু করতে না পারা একটি বিরাট ক্ষতি। এত বিশাল বিনিয়োগ করা হয়েছে, অথচ যদি এর থেকে কোনো কার্যকর রিটার্ন আসে না, তবে এটি দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। রেলওয়ে সব সময় বিলাসী ও আধুনিক অবকাঠামোর পেছনে ছুটেছে, কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজন ও পরিকল্পনার ঘাটতি অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে। আইকনিক স্টেশন এর একটি চমৎকার উদাহরণ। এখনই যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনা হয়, তবে এই বিশাল বিনিয়োগ শুধু খালি বিলাসিতা হিসেবেই থেকে যাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক রিটার্ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত