Ajker Patrika

ইমাম বুখারির করুণ বিদায়: জ্ঞানীর প্রতিদান যখন নির্বাসন

রায়হান আল ইমরান
ইমাম বুখারির মাজার। ছবি: সংগৃহীত
ইমাম বুখারির মাজার। ছবি: সংগৃহীত

তখনো শেষ হয়নি সেই স্বর্ণালি যুগ। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে। জ্ঞানের একজন শ্রেষ্ঠ বাহক তখন জন্ম নিয়েছিলেন বুখারা অঞ্চলে। নাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল আল-বুখারি (রহ.)। যাঁর হাত ধরে হাদিস শাস্ত্র পেয়েছিল এমন এক দীপ্তিমান আলো, যা আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণধী ও অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী। আল্লাহ তাঁকে এমন এক মেধা দিয়েছিলেন, যা ছিল অতুলনীয়। একাধারে সাহসী, বিনয়ী ও জ্ঞানসাগরের মাঝি ছিলেন তিনি। জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন হেজাজ, ইরাক, মিসর ও বিভিন্ন দেশের পথে পথে; হাদিস সংগ্রহ, যাচাই ও সংকলনে।

একবার তিনি নিশাপুর নামক একটি অঞ্চলে রওনার মনস্থ করেন। সেখানকার অধিবাসীরা তাঁর আগমনী সংবাদ জানতে পেরে অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তদানীন্তন সময়ে সেই অঞ্চলের একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া জুহালি (রহ.)। তিনিও প্রস্তুতি নেন অভ্যর্থনা জানানোর। তবে একটি মাসআলা নিয়ে ইমাম বুখারি (রহ.)-এর মতের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই অমিল ছিল। তাই নিশাপুরবাসীকে সতর্ক করেন, সেই মাসআলা সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস না করতে। মাসআলাটি ছিল—কোরআন সৃষ্ট (মাখলুক) কি না। ইমাম বুখারি (রহ.)-এর অভিমত ছিল, কোরআনের শব্দাবলি সৃষ্টি; তবে লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরআন সৃষ্ট (মাখলুক) নয়। আর ইমাম জুহালি (রহ.)-এর মতো ছিল, কোনো কোরআনই সৃষ্ট নয়।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বুখারি (রহ.) যাত্রা শুরু করেন নিশাপুরের দিকে। এদিকে অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন সেই অঞ্চলের অধিবাসীরা। বুখারি (রহ.) খুব কাছে চলে এলে অভ্যর্থনা জানাতে অনেক দূরে এগিয়ে গেলেন তাঁরা। ইমাম মুসলিম (রহ.) বলেন, নিশাপুরের ইতিহাসে কাউকে কখনো এমন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। ইমাম বুখারি (রহ.) প্রবেশ করলেন নিশাপুর অঞ্চলে। সেখানে শুরু করেন হাদিস পাঠদান। তখন থেকেই তাঁর হাদিসের আসরে জড়ো হন হাজার হাজার ব্যক্তিবর্গ। হঠাৎ কোনো একদিন তাঁর এক শিষ্য প্রশ্ন করে বসেন, কোরআন সৃষ্ট কি না? অনেকেই তখন বুখারি (রহ.)-কে বারণ করার চেষ্টা করেন এবং এর মন্দ পরিণাম সম্পর্কে অবহিত করেন; কিন্তু উদ্বিগ্নহীন জবাব দেন, ‘আমাদের কর্মসমূহ সৃষ্ট, আর কোরআনের শব্দাবলি আমাদের কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মজলিশে দেখা দেয় একধরনের অস্থিতিশীলতা। পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘরের কর্তা তখন বুখারিসহ (রহ.) কয়েকজন ব্যতীত সবাইকে মজলিশ ত্যাগে বাধ্য করেন। এদিকে এ খবর ইমাম জুহালি (রহ.)-এর কাছে পৌঁছে গেলে তিনি ফতোয়া দেন, ‘কোরআন আল্লাহর বাক্য—যা সৃষ্ট (মাখলুক) নয়। যে ব্যক্তি সৃষ্ট বলবে, সে একজন বিদআতি হিসেবে বিবেচিত হবে। তার সঙ্গে বসা যাবে না, কথাও বলা যাবে না। এ ঘোষণার পরেও যদি কেউ মুহাম্মাদ বিন ইসমাইলের হাদিসের আসরে বসে, তাহলে তোমরা তাকে সন্দেহ করো। কারণ, কেবল সেই ব্যক্তিরাই সেখানে বসবে, যারা তাঁর অনুসারী।’

এদিকে ইমাম বুখারি (রহ.) গভীরভাবে অবস্থার পর্যবেক্ষণ করেন। তখন পরিবেশ অনুকূলে না পেয়ে দ্রুত নিশাপুর ছাড়েন এবং রওনা দেন স্বদেশ বুখারার উদ্দেশে। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো অপপ্রচার—ইমাম বুখারি গোমরাহি ছড়াচ্ছেন! এই অভিযোগে তাঁকে নিজ শহরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

নির্বাসনের নিদারুণ যাতনা

নিজ জন্মভূমিতে আশ্রয় না পেয়ে বুখারি (রহ.) আশ্রয় নিলেন এক ক্ষুদ্র জনপদে তথা খারতাঙ্ক নামক স্থানে—যা ছিল সমরকন্দের কাছাকাছি। সেই জনমানবহীন নিঃসঙ্গ গ্রামই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয়। দিনগুলো তখন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। তখন কিছু সময়ের জন্য তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, পৃথিবী আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, যদিও তা বিস্তৃত। আমাকে নিজ সান্নিধ্যে তুলে নাও।’ এরপর হিজরি ২৫৬ সনে তিনি পাড়ি জমালেন মহান রবের কাছে।

ইমাম বুখারি (রহ.) চিরবিদায় গ্রহণ করলেন; কিন্তু রেখে গেলেন এমন অনেক সম্পদ—যা তাঁর অবদানের চিরস্মরণীয় স্মারক হয়ে আছে। এর মধ্যে তাঁর যুগ বিখ্যাত সহিহ্ আল-বুখারি ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করেছে। ইমাম বুখারি (রহ.)-এর জীবনের এই অধ্যায় শুধু একজন কিংবদন্তির নির্যাতনের ইতিহাস নয়; বরং এক সত্যসন্ধানীর দৃঢ়তার গল্প। তিনি দেখিয়ে গেছেন, সত্যকে কীভাবে আঁকড়ে ধরতে হয়। (কিতাবুল মাদখাল ইলা সহিহিল বুখারি, পৃ. ৪৭-৫৬, সিগনাতুরা, ইস্তাম্বুল: ২০১৯)

লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

সখীপুরে বনপ্রহরীদের ওপর হামলা: ইউপি সদস্য, বিএনপি নেতাসহ ৭ জনের নামে মামলা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত