ইসলাম ডেস্ক
মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুগে যুগে বহু ক্ষণজন্মা মনীষীর আগমন ঘটেছে, যাঁরা তাঁদের কর্ম ও প্রজ্ঞা দিয়ে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছেন। তাঁরা জাতির ভাগ্য রচনা করে নিজেদের অমর করে রেখেছেন।
তবে এ সকল মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদিন (রা.)-এর মর্যাদা যেমন অতীত ইতিহাসে বিরল, তেমনি ভবিষ্যতেও তা অতুলনীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা কেবল ইসলামের রাজনৈতিক নেতৃত্বই দেননি, বরং নববী আদর্শের খাঁটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে মানবজাতির সামনে এক অনন্য জীবনদর্শন রেখে গেছেন।
এই চার খলিফার মধ্যে বিশেষভাবে দ্বিতীয় খলিফা, আমিরুল মুমিনিন ফারুকে আজম হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব ও কীর্তি এক অসাধারণ উচ্চতা স্পর্শ করেছে। তাঁর মতো মর্যাদা সিদ্দিকে আকবর হজরত আবু বকর (রা.)-এর পর আর কারও পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর দক্ষ নেতৃত্ব, ন্যায়বিচারের প্রতি অনমনীয় অঙ্গীকার এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার মহিমা চিরকাল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
নবীজি (সা.)-এর প্রশংসাপূর্ণ বাণী ও আল-ফারুক উপাধি
হজরত উমর (রা.) সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাঁর বহুমুখী গুণাবলির সাক্ষ্য স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। এই গুণাবলির কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেছিলেন, যা আল্লাহ কবুলও করেছিলেন। ফলস্বরূপ, তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই ইসলামের প্রসার ও বিজয় আরও সুদৃঢ় হতে থাকে।
নবুওয়াতের দরবার থেকে তিনি ‘আল-ফারুক’ উপাধি লাভ করেন, যা উম্মতের আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। এর অর্থ—‘সত্য-মিথ্যার মাঝে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণকারী’। এই উপাধি হজরত উমর (রা.)-এর সত্যপ্রেম ও সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার গুণ প্রকাশ করে। সত্যের ব্যাপারে তিনি কারও মর্যাদা বা প্রভাবের পরোয়া করতেন না। এমনকি নিজের প্রাণ বা সম্পদের ক্ষতিরও ভয় করতেন না। কোনো বিষয় পুরোপুরি অনুধাবন না হওয়া পর্যন্ত তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বারবার প্রশ্ন করতেন।
তাঁর মহামানবীয় সত্তা ছিল সরলতার প্রতীক। আর তাঁর জীবন ছিল সত্য ও নিষ্কলুষতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন রাসুলের (সা.) সত্যিকারের প্রেমিক, ইসলাম ও মুসলমানদের একনিষ্ঠ সেবক। মুনাফিক ও আল্লাহর শত্রুরা ছিল তাঁর জাতশত্রু। যারা সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত এবং অবাধ্যতায় লিপ্ত হতো, তাদের জন্য তিনি ছিলেন খোলা তলোয়ার। সুপরিকল্পনা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সাহস ও উদারতা, মর্যাদা, ন্যায়বিচার, আল্লাহর ভয়, পরকালীন জীবনের ভাবনা এবং মুসলমানদের অধিকার রক্ষার পূর্ণ দায়িত্বশীলতার গুণে তিনি ভূষিত ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেছেন—‘যদি আমার পরেও নবুওয়াতের ধারা চলমান থাকত, তাহলে আমার পর উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) নবী হতেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৮৬)। যদি হজরত উমর (রা.)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে আর কোনো হাদিস না-ও থাকত, তাহলে এই একটি হাদিসই তাঁর মর্যাদা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ হাদিস ভান্ডারে তাঁর মর্যাদা সংক্রান্ত বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
এই হাদিসের আলোকে হজরত উমর (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, নবী ও রাসুলগণ মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে সমাসীন থাকেন। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রতিজন নবীর মধ্যে তাঁর মর্যাদার উপযুক্ত সব গুণাবলি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। তিনি বংশ-মর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং ব্যক্তিগত গুণাবলির ক্ষেত্রেও সবার ওপরে থাকেন। এই হাদিস থেকে জানা যায় যে, নবীদের মধ্যে যে গুণাবলি থাকে, আল্লাহ তাআলা হজরত উমর (রা.)-কেও সেই সব গুণাবলি দ্বারা বিভূষিত করেছিলেন।
জীবন এবং আদর্শ
ফারুকে আজম (রা.)-এর জীবনকে তিনটি সময়ে ভাগ করা যায়:
এই তিন সময়ের প্রতিটি পর্যায়েই তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন সব গুণাবলি বিদ্যমান ছিল, যার কারণে তিনি সমসাময়িকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় অগ্রগণ্য ছিলেন। কুফরের যুগে, তার শৈশব আরবদের রীতিনীতির মতো উট চরানোর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। অতঃপর তিনি সেই সময়ের মানদণ্ড অনুযায়ী পড়াশোনা ও উৎকৃষ্ট বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জনে মনোযোগ দেন।
এর পাশাপাশি কুস্তি, শারীরিক শক্তি, ঘোড়সওয়ারি, যুদ্ধবিদ্যা ও সামরিক কৌশল, প্রভাবশালী বক্তব্য, বাগ্মিতা, সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা, সাহসিকতা ও নির্ভীকতা এবং মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতার মতো বহু গুণাবলি তাঁর মাঝে প্রকাশিত হয়।
এসব গুণের কারণে কুরাইশ গোত্র তাঁকে সম্মানিত নেতাদের মধ্যে গণ্য করে এবং কূটনৈতিক দায়িত্বের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়। বিভিন্ন গোত্র এমনকি কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গেও তিনি কুরাইশদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর দ্বিতীয় উজ্জ্বল সময়কাল ছিল ইসলামের যুগ। ইসলামের আলো এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে তাঁর গুণাবলি ও চরিত্র আরও উজ্জ্বল ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন—‘আল্লাহ তাআলা উমরের অন্তর ও জিহ্বায় সত্য প্রবাহিত করে দিয়েছেন।’ অর্থাৎ, তাঁর অন্তরে যা উদয় হবে তা-ই সত্য হবে এবং তাঁর জিহ্বা থেকে যা উচ্চারিত হবে তা সত্য বৈ কিছু হতে পারে না।
বহুবার এমন ঘটেছে যে, হজরত উমর (রা.)-এর মতের সঙ্গে মিল রেখে রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর ওহি নাজিল হয়েছে। যেমন—বদরের যুদ্ধে বন্দীদের বিষয়ে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের পর্দার বিধান সংক্রান্ত বিষয়ে।
তাঁর মতামত এতটাই সঠিক ও সুচিন্তিত হতো যে, তিনি নিজেই বলেছেন—‘আমি যখনই কারও বিষয়ে কোনো মতামত দিয়েছি, সেটি যথাযথ ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরামর্শের ওপর এতটাই আস্থা রাখতেন যে তিনি বলেছেন—‘দুনিয়াতে প্রত্যেক নবীর দুজন করে উজির থাকে। আর আমার উজির হলেন আবু বকর ও উমর।’ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা হালকা পরামর্শযোগ্য বিষয়েও রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া চূড়ান্ত করতেন না।
খিলাফতের স্বর্ণযুগ
তাঁর জীবনের তৃতীয় সময়কাল, যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবময় ছিল, তা হলো তাঁর খিলাফত ও শাসনকাল। এ সময়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশ পায়। একজন সফল ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য যেসব গুণ ও যোগ্যতা প্রয়োজন, তা তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
অথচ তাঁর পরিবারে এর আগে কখনো কেউ রাজা হয়নি, যাতে শাসন কুশলতা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা তৈরি হতে পারে। শৈশবে যখন তিনি উট চরাতেন, তখন শাসনকাজ শেখার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া আরবের হিজাজ অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে কোনো রাজ্য-রাজার ব্যবস্থাও বিদ্যমান ছিল না।
তাঁর জীবনে শাসন কুশলতা শেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি এমন সব শাসননীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় থাকবে। তিনি এমন শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করেন যা একটি সফল সরকারের জন্য অপরিহার্য; রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সুপরিকল্পনা ও প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা, শাসন মর্যাদার গাম্ভীর্য, অশান্তি দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের উৎসাহ প্রদান, আত্মীয়প্রীতি থেকে বিরত থাকা এবং পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য অত্যন্ত সাদামাটা, বরং দরিদ্রসুলভ ও সংযমী জীবনযাপন—এসবই ছিল তাঁর গুণাবলি।
ন্যায়বিচারে তিনি এমন উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেন যে, ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে পরিচিত নওশেরওয়াহ-এর যুগেও ইতিহাসে কিছু অবিচারের ঘটনা পাওয়া যায়; কিন্তু ফারুকি যুগের ইতিহাস এমন একটি ঘটনাও পেশ করতে পারেনি যাতে অবিচারের সামান্য ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায়। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তিনি নিজের, আত্মীয়স্বজনের এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও কোনো প্রকার ছাড় দিতেন না। ন্যায়ের ক্ষেত্রে তাঁর কাছে সবাই সমান ছিল।
একবার এক সাহাবির সঙ্গে তাঁর বিরোধ মীমাংসার জন্য মামলা আদালতে ওঠে। তিনি মদিনার কাজির আদালতে হাজির হন। কাজি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর জন্য আসন খালি করে দেন, কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন—‘তুমি তো এই মামলায় প্রথমেই অবিচার করে ফেলেছ।’ তারপর তিনি নিজেই উঠে গিয়ে অপর পক্ষের পাশে বসেন।
তাঁর শাসনামলে তাঁর জীবনযাপন এতটাই সহজ ছিল যে, তিনি যে খলিফা এটা বোঝার বাহ্যিক কোনো লক্ষণ ছিল না। তিনি সাধারণ খাবার খেতেন। প্রায়শই যবের রুটি জায়তুন তেল দিয়ে খেতেন। খসখসে মোটা তালি দেওয়া কাপড় পড়তেন। একবার তাঁর জামায় বারোটি তালি পাওয়া গিয়েছিল।
রাতের বেলায় তিনি নিঃশব্দে শহরে ঘুরে বেড়াতেন, মানুষের অভিযোগ খোলা মনে শুনতেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের সাহায্য করতেন। মুসলমানদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতেন এবং অমুসলিমদের সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ, শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুগে যুগে বহু ক্ষণজন্মা মনীষীর আগমন ঘটেছে, যাঁরা তাঁদের কর্ম ও প্রজ্ঞা দিয়ে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছেন। তাঁরা জাতির ভাগ্য রচনা করে নিজেদের অমর করে রেখেছেন।
তবে এ সকল মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদিন (রা.)-এর মর্যাদা যেমন অতীত ইতিহাসে বিরল, তেমনি ভবিষ্যতেও তা অতুলনীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা কেবল ইসলামের রাজনৈতিক নেতৃত্বই দেননি, বরং নববী আদর্শের খাঁটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে মানবজাতির সামনে এক অনন্য জীবনদর্শন রেখে গেছেন।
এই চার খলিফার মধ্যে বিশেষভাবে দ্বিতীয় খলিফা, আমিরুল মুমিনিন ফারুকে আজম হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব ও কীর্তি এক অসাধারণ উচ্চতা স্পর্শ করেছে। তাঁর মতো মর্যাদা সিদ্দিকে আকবর হজরত আবু বকর (রা.)-এর পর আর কারও পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর দক্ষ নেতৃত্ব, ন্যায়বিচারের প্রতি অনমনীয় অঙ্গীকার এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার মহিমা চিরকাল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
নবীজি (সা.)-এর প্রশংসাপূর্ণ বাণী ও আল-ফারুক উপাধি
হজরত উমর (রা.) সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাঁর বহুমুখী গুণাবলির সাক্ষ্য স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। এই গুণাবলির কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেছিলেন, যা আল্লাহ কবুলও করেছিলেন। ফলস্বরূপ, তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই ইসলামের প্রসার ও বিজয় আরও সুদৃঢ় হতে থাকে।
নবুওয়াতের দরবার থেকে তিনি ‘আল-ফারুক’ উপাধি লাভ করেন, যা উম্মতের আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। এর অর্থ—‘সত্য-মিথ্যার মাঝে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণকারী’। এই উপাধি হজরত উমর (রা.)-এর সত্যপ্রেম ও সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার গুণ প্রকাশ করে। সত্যের ব্যাপারে তিনি কারও মর্যাদা বা প্রভাবের পরোয়া করতেন না। এমনকি নিজের প্রাণ বা সম্পদের ক্ষতিরও ভয় করতেন না। কোনো বিষয় পুরোপুরি অনুধাবন না হওয়া পর্যন্ত তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বারবার প্রশ্ন করতেন।
তাঁর মহামানবীয় সত্তা ছিল সরলতার প্রতীক। আর তাঁর জীবন ছিল সত্য ও নিষ্কলুষতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন রাসুলের (সা.) সত্যিকারের প্রেমিক, ইসলাম ও মুসলমানদের একনিষ্ঠ সেবক। মুনাফিক ও আল্লাহর শত্রুরা ছিল তাঁর জাতশত্রু। যারা সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত এবং অবাধ্যতায় লিপ্ত হতো, তাদের জন্য তিনি ছিলেন খোলা তলোয়ার। সুপরিকল্পনা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সাহস ও উদারতা, মর্যাদা, ন্যায়বিচার, আল্লাহর ভয়, পরকালীন জীবনের ভাবনা এবং মুসলমানদের অধিকার রক্ষার পূর্ণ দায়িত্বশীলতার গুণে তিনি ভূষিত ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেছেন—‘যদি আমার পরেও নবুওয়াতের ধারা চলমান থাকত, তাহলে আমার পর উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) নবী হতেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৮৬)। যদি হজরত উমর (রা.)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে আর কোনো হাদিস না-ও থাকত, তাহলে এই একটি হাদিসই তাঁর মর্যাদা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ হাদিস ভান্ডারে তাঁর মর্যাদা সংক্রান্ত বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
এই হাদিসের আলোকে হজরত উমর (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, নবী ও রাসুলগণ মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে সমাসীন থাকেন। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রতিজন নবীর মধ্যে তাঁর মর্যাদার উপযুক্ত সব গুণাবলি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। তিনি বংশ-মর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং ব্যক্তিগত গুণাবলির ক্ষেত্রেও সবার ওপরে থাকেন। এই হাদিস থেকে জানা যায় যে, নবীদের মধ্যে যে গুণাবলি থাকে, আল্লাহ তাআলা হজরত উমর (রা.)-কেও সেই সব গুণাবলি দ্বারা বিভূষিত করেছিলেন।
জীবন এবং আদর্শ
ফারুকে আজম (রা.)-এর জীবনকে তিনটি সময়ে ভাগ করা যায়:
এই তিন সময়ের প্রতিটি পর্যায়েই তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন সব গুণাবলি বিদ্যমান ছিল, যার কারণে তিনি সমসাময়িকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় অগ্রগণ্য ছিলেন। কুফরের যুগে, তার শৈশব আরবদের রীতিনীতির মতো উট চরানোর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। অতঃপর তিনি সেই সময়ের মানদণ্ড অনুযায়ী পড়াশোনা ও উৎকৃষ্ট বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জনে মনোযোগ দেন।
এর পাশাপাশি কুস্তি, শারীরিক শক্তি, ঘোড়সওয়ারি, যুদ্ধবিদ্যা ও সামরিক কৌশল, প্রভাবশালী বক্তব্য, বাগ্মিতা, সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা, সাহসিকতা ও নির্ভীকতা এবং মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতার মতো বহু গুণাবলি তাঁর মাঝে প্রকাশিত হয়।
এসব গুণের কারণে কুরাইশ গোত্র তাঁকে সম্মানিত নেতাদের মধ্যে গণ্য করে এবং কূটনৈতিক দায়িত্বের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়। বিভিন্ন গোত্র এমনকি কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গেও তিনি কুরাইশদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর দ্বিতীয় উজ্জ্বল সময়কাল ছিল ইসলামের যুগ। ইসলামের আলো এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে তাঁর গুণাবলি ও চরিত্র আরও উজ্জ্বল ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন—‘আল্লাহ তাআলা উমরের অন্তর ও জিহ্বায় সত্য প্রবাহিত করে দিয়েছেন।’ অর্থাৎ, তাঁর অন্তরে যা উদয় হবে তা-ই সত্য হবে এবং তাঁর জিহ্বা থেকে যা উচ্চারিত হবে তা সত্য বৈ কিছু হতে পারে না।
বহুবার এমন ঘটেছে যে, হজরত উমর (রা.)-এর মতের সঙ্গে মিল রেখে রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর ওহি নাজিল হয়েছে। যেমন—বদরের যুদ্ধে বন্দীদের বিষয়ে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের পর্দার বিধান সংক্রান্ত বিষয়ে।
তাঁর মতামত এতটাই সঠিক ও সুচিন্তিত হতো যে, তিনি নিজেই বলেছেন—‘আমি যখনই কারও বিষয়ে কোনো মতামত দিয়েছি, সেটি যথাযথ ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরামর্শের ওপর এতটাই আস্থা রাখতেন যে তিনি বলেছেন—‘দুনিয়াতে প্রত্যেক নবীর দুজন করে উজির থাকে। আর আমার উজির হলেন আবু বকর ও উমর।’ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা হালকা পরামর্শযোগ্য বিষয়েও রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া চূড়ান্ত করতেন না।
খিলাফতের স্বর্ণযুগ
তাঁর জীবনের তৃতীয় সময়কাল, যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবময় ছিল, তা হলো তাঁর খিলাফত ও শাসনকাল। এ সময়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশ পায়। একজন সফল ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য যেসব গুণ ও যোগ্যতা প্রয়োজন, তা তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
অথচ তাঁর পরিবারে এর আগে কখনো কেউ রাজা হয়নি, যাতে শাসন কুশলতা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা তৈরি হতে পারে। শৈশবে যখন তিনি উট চরাতেন, তখন শাসনকাজ শেখার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া আরবের হিজাজ অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে কোনো রাজ্য-রাজার ব্যবস্থাও বিদ্যমান ছিল না।
তাঁর জীবনে শাসন কুশলতা শেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি এমন সব শাসননীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় থাকবে। তিনি এমন শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করেন যা একটি সফল সরকারের জন্য অপরিহার্য; রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সুপরিকল্পনা ও প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা, শাসন মর্যাদার গাম্ভীর্য, অশান্তি দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের উৎসাহ প্রদান, আত্মীয়প্রীতি থেকে বিরত থাকা এবং পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য অত্যন্ত সাদামাটা, বরং দরিদ্রসুলভ ও সংযমী জীবনযাপন—এসবই ছিল তাঁর গুণাবলি।
ন্যায়বিচারে তিনি এমন উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেন যে, ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে পরিচিত নওশেরওয়াহ-এর যুগেও ইতিহাসে কিছু অবিচারের ঘটনা পাওয়া যায়; কিন্তু ফারুকি যুগের ইতিহাস এমন একটি ঘটনাও পেশ করতে পারেনি যাতে অবিচারের সামান্য ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায়। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তিনি নিজের, আত্মীয়স্বজনের এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও কোনো প্রকার ছাড় দিতেন না। ন্যায়ের ক্ষেত্রে তাঁর কাছে সবাই সমান ছিল।
একবার এক সাহাবির সঙ্গে তাঁর বিরোধ মীমাংসার জন্য মামলা আদালতে ওঠে। তিনি মদিনার কাজির আদালতে হাজির হন। কাজি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর জন্য আসন খালি করে দেন, কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন—‘তুমি তো এই মামলায় প্রথমেই অবিচার করে ফেলেছ।’ তারপর তিনি নিজেই উঠে গিয়ে অপর পক্ষের পাশে বসেন।
তাঁর শাসনামলে তাঁর জীবনযাপন এতটাই সহজ ছিল যে, তিনি যে খলিফা এটা বোঝার বাহ্যিক কোনো লক্ষণ ছিল না। তিনি সাধারণ খাবার খেতেন। প্রায়শই যবের রুটি জায়তুন তেল দিয়ে খেতেন। খসখসে মোটা তালি দেওয়া কাপড় পড়তেন। একবার তাঁর জামায় বারোটি তালি পাওয়া গিয়েছিল।
রাতের বেলায় তিনি নিঃশব্দে শহরে ঘুরে বেড়াতেন, মানুষের অভিযোগ খোলা মনে শুনতেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের সাহায্য করতেন। মুসলমানদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতেন এবং অমুসলিমদের সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ, শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
আমরা কোরআন ও হাদিসের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখতে পাই এমন কিছু ভালোবাসার কথা বর্ণিত হয়েছে, যেসব মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রিয় করে তোলে। ইহ-পরকালীন সম্মানে তাকে ভূষিত করে। পার্থিব জীবনেও দেয় শান্তি-স্বস্তি। এমন কিছু ভালোবাসার বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো—
৪ ঘণ্টা আগেদানশীলতা ও উদারতা ছিল মহানবী (সা.)-এর চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর এই গুণ ছিল সর্বজনবিদিত। হাদিস এসেছে, ‘রাসুল (সা.) সব মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন।’ (সহিহ্ বুখারি)। দানশীল ব্যক্তিদের একটি বিশেষ গুণ হলো, তাঁরা অতিথিদের খুব আদর-আপ্যায়ন করেন
১১ ঘণ্টা আগেমানুষের স্বভাবজাত দুইটি বৈশিষ্ট্য হলো কোমলতা ও কঠোরতা। তবে মানবিক সম্পর্ক, সামাজিক সংহতি, এমনকি আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগেও প্রয়োজন হয় হৃদয়ের কোমলতা ও নম্রতার। কারণ সম্পর্ক গড়ে উঠে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিক আচরণের মধ্যে দিয়ে। আর রূঢ় ও কঠোরতায় সম্পর্কের বিনাশ ঘটে।
১ দিন আগেআল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ দুনিয়ায় আসে অল্প সময়ের জন্য—শূন্য হাতে জন্ম, শূন্য হাতেই বিদায়। জন্ম যাত্রার সূচনা, মৃত্যু তার অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)
১ দিন আগে