Ajker Patrika

হিজরত যেভাবে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল

কাউসার লাবীব
হিজরত যেভাবে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করেন। এই সময় তিনি মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। এক যুগের বেশি সময় তিনি দিনরাত এক করে মক্কার মরুপ্রান্তরে এই মেহনত চালিয়ে যান। এতে তিনি কখনো ক্লান্ত হননি, হতাশ হননি, বিরক্ত হননি এবং নিরাশও হননি। আল্লাহ তাআলা তাঁর হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেলে দিতেন। আল্লাহর বিশেষ দয়া তাঁকে ঘিরে রাখত।

যেভাবে হিজরতের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়

নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে ইসলামের দাওয়াত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। কোনো হুমকি-ধমকি তাঁকে থামাতে পারেনি। সত্যের পথে তিনি ছিলেন অবিচল। ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছাতে যত পন্থা সম্ভব ছিল, সব পথেই তিনি হেঁটেছেন, প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়েছেন, প্রতিটি সমাবেশ-জমায়েতে উপস্থিত হয়েছেন, গোত্রে গোত্রে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন, বিশেষ ব্যক্তিদের আলাদা করে দাওয়াত দিয়েছেন—এই আশায়, হয়তো কেউ সত্যের পথে তাঁর সঙ্গী হবে, এক আল্লাহর ওপর ইমান আনবে, ইসলাম প্রচারে তাঁর সহযোগী হবে।

মক্কার কিছু মানুষ নবী (সা.)-এর দাওয়াতে বিশ্বাস করেছিল—যাদের আত্মা ছিল উন্নত, হৃদয় ছিল পবিত্র। ধীরে ধীরে ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূর্তিপূজার অসারতা থেকে মানুষ সচেতন হতে থাকে। ধীরে কিন্তু সুনিপুণভাবে চলতে থাকে মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি কার্যক্রম। তাঁর দাওয়াতের সফলতা মক্কার নেতৃস্থানীয় কাফেরদের কপালে ভাঁজ ফেলে। তারা যখন বুঝতে পারে, এভাবে চললে তাদের ধর্মীয় মর্যাদা ও নেতৃত্ব বিপদের মুখে পড়বে, তখন তারা নবীজি (সা.)-এর ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে। ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। শারীরিক নিপীড়ন, কারাবাস এমনকি হত্যার শিকার হয় অনেকে। এসবের মাঝেই নবী (সা.) বিভিন্ন আরব গোত্রের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। বিশেষ করে তিনি হজ মৌসুমকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন।

হিজরতের প্রস্তুতি

নবী (সা.)-এর নিরলস প্রচেষ্টা অবশেষে ফল দিতে শুরু করে। এক হজ মৌসুমে খাজরাজ গোত্রের ছয়জন ব্যক্তি তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন, ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) ফিরে গিয়ে ইসলাম প্রচার করবেন এবং তাঁকে সহযোগিতা করবেন। এক বছর পর হজ মৌসুমে ইয়াসরিবের ১২ জন ব্যক্তি এসে নবীর সঙ্গে প্রথম আকাবা সন্ধি করেন। এই সন্ধিতে তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে শরিক না করা, চুরি না করা, ব্যভিচার না করা, সন্তান হত্যা না করা ইত্যাদি শপথ করেন। সেই ১২ জন যখন ইয়াসরিবে ফিরে যান, নবী (সা.) তাঁদের সঙ্গে পাঠান জ্ঞানী, মেধাবী ও পরিশ্রমী ইসলাম প্রচারক মুসআব ইবনে উমাইরকে। তিনি এমনভাবে ইসলাম প্রচার করেন, ইয়াসরিবের প্রতিটি ঘরে ইসলাম পৌঁছে যায়। তিনিই ইয়াসরিবকে হিজরতের উপযুক্ত স্থান হিসেবে প্রস্তুত করেন। পরবর্তী বছর হজ মৌসুমে ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী মদিনা থেকে এসে নবী (সা.)-এর সঙ্গে দ্বিতীয় আকাবা সন্ধি করেন। এই সন্ধিতে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন, ‘নবী (সা.) যদি তাঁদের এলাকায় হিজরত করেন, তবে তাঁকে তাঁরা রক্ষা করবেন, তাঁর পাশে থাকবেন এবং জীবন দিয়ে তাঁর সুরক্ষা করবেন।’

মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে

দ্বিতীয় আকাবা সন্ধির পর নবী (সা.) সাহাবিদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। তখন কেউ একা, কেউ দল বেঁধে, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে মদিনায় হিজরত করতে থাকেন। ধীরে ধীরে অধিকাংশ মুসলমানই হিজরত করে ফেলেন। মক্কায় অবশিষ্ট থাকেন নবী (সা.) এবং অল্প কিছু সাহাবি। এ সময় মক্কার কাফেররা ভাবে—‘ইয়াসরিবে গিয়ে মুহাম্মদ যদি তাঁর অনুসারীদের সুসংগঠিত করতে পারেন, একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারেন—তাতে কুরাইশের মর্যাদা, নেতৃত্ব এবং বাণিজ্য—সবকিছুর ওপরই আঘাত আসবে।’ তাই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়—এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আগেই নবী (সা.)-কে হত্যা করবে। যে রাতে তাঁকে হত্যা করা হবে, সে রাতেই তিনি আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবের পথ ধরেন।

ইয়াসরিব যেভাবে মদিনা হলো

নবী (সা.)-এর হিজরতের সময় ইয়াসরিব প্রচলিত অর্থে কোনো নগরী ছিল না। বরং এটি ছিল বিস্তৃত এক সমভূমিতে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি জলাধারকেন্দ্রিক বসতি। এখানে বাস করত আউস ও খাজরাজ নামক দুটি আরব গোত্র এবং একাধিক ইহুদি সম্প্রদায়। তিনি এই এলাকাকে নগর হিসেবে গঠনে উদ্যোগী হন। ইয়াসরিবকে তিনি নগর হিসেবে গুছিয়ে তোলেন। রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মুছে দেন। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে।

এই নগর বিনির্মাণের মূল ভিত্তি ছিল মসজিদ। মসজিদে নববি। এই মসজিদ শুধু নামাজের স্থানই ছিল না; এটিই ছিল রাষ্ট্রের কেন্দ্র—এখানেই নামাজ হতো, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হতো, যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ে পরামর্শ হতো, প্রতিনিধিদল আসত এবং এখানে নবী (সা.)-এর বাসভবনও ছিল, যা থেকে তিনি সরাসরি মসজিদে প্রবেশ করতে পারতেন। এই মসজিদ কেন্দ্র করেই ইয়াসরিবের নতুন জনবসতি গড়ে ওঠে। শহরের রাস্তাঘাট সুচারুভাবে বিন্যস্ত হয়। নাম পাল্টে হয় মদিনা। মদিনাতুর রাসুল।

হিজরি সনের সূচনা হয় যেভাবে

আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন গণনা শুরু হয় হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে, যা ইতিহাসে যুক্ত করে নতুন পালক। ঘুরিয়ে দেয় ইতিহাসের মোড়। রাষ্ট্রীয় কাজ সুচারুভাবে পালনের জন্য ওমর (রা.) নতুন সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য ডাকেন পরামর্শ সভা। সভায় নবী (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, নবুওয়াত ও হিজরত—এই চার বিষয়কে কেন্দ্র করে বর্ষ গণনার প্রস্তাব আসে। ওমর (রা.) হজরত আলী (রা.)-এর প্রস্তাবকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন বর্ষ গণনার জন্য হিজরতকে বেছে নেন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ২৪ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) হিজরত করেন। সে বছরকে সূচনা বছর ধরে শুরু হয় হিজরি সন।

তথ্যসূত্র: ইসলাম অনলাইন ডটনেট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত