Ajker Patrika

আল্লাহর সঙ্গে মুসা (আ.) নবীর কথোপকথনের স্থানকে পর্যটন কেন্দ্র বানানো নিয়ে বিতর্ক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার
সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার

ছবিতে যে স্থানটি দেখতে পাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত জাবালে মুসা নামে। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই নবী মুসা (আ.)-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন আল্লাহ। পবিত্র কোরআন আর বাইবেলে বর্ণনা এমনি। এ ছাড়া, ষষ্ঠ শতকের সেন্ট ক্যাথেরিন মঠও এখানে অবস্থিত। এটি পরিচালনা করে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ।

বাংলাদেশে অনেকের কাছে তুর পাহাড় নামে পরিচিত হলেও এর প্রকৃত নাম সিনাই পর্বত। আরবিতে যেটিকে বলা হয় তুরে সিনাই। আরবিতে তুরের অর্থ পাহাড়। বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে এই স্থানের আলাদা আবেদন রয়েছে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদীদের কাছে। যে কারণে, সারা বছরই এখানে এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের আনাগোনা থাকে।

তবে, সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম এই তীর্থস্থানে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মিসর। এ নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থানটিতে এখন গড়ে উঠছে বিলাসবহুল হোটেল, ভিলা এবং মার্কেট।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই স্থানে জেবেলিয়া নামক এক বেদুইন সম্পদায়ের বসবাস। বিলাসবহুল হোটেল ও মার্কেট নির্মাণের লক্ষ্যে এরই মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে তাদের অনেকের বাড়ি-ঘর। অভিযোগ রয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা বা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। আরও গুরুতর অভিযোগ হলো—সমাধিস্থল থেকে স্বজনদের মরদেহও তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার
সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার

সিনাইয়ের আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ব্রিটিশ লেখক বেন হফলার। তাঁর মতে, এই প্রকল্পকে দেশের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ও টেকসই উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে, এই প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ হতে হচ্ছে স্থানীয়দের। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জেবেলিয়া গোষ্ঠীর কাছে এটি উন্নয়ন নয়। তাঁরা কখোনো এটা চাননি। এটা তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিকল্পনায় স্থানীয়দের চেয়ে বহিরাগতদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতে স্থানীয়দের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, সিনাইয়ে প্রায় ৪ হাজার জেবেলিয়া বেদুইনের বসবাস। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যা হচ্ছে তা নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ তাঁরা।

এখন পর্যন্ত মিসরের এই পরিকল্পনা নিয়ে সবচেয়ে সরব অবস্থান নিয়েছে গ্রিস। সেন্ট ক্যাথরিন মঠের সঙ্গে দেশটির ঐতিহাসিক সম্পর্কই এর মূল কারণ।

চলতি বছরের মে মাসে একটি মিসরীয় আদালত রায় দেয়, বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সক্রিয় খ্রিস্টান মঠ সেন্ট ক্যাথরিন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে অবস্থিত। কয়েক দশক ধরে চলা বিরোধের পর বিচারকেরা বলেন, মঠটির জমি ও আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ধর্মীয়-পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও সেগুলোর মালিকানা মঠের নয়।

এ রায়ের পর থেকেই কায়রো ও এথেন্সের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। গ্রিসের চার্চ প্রধান আর্চবিশপ দ্বিতীয় ইয়েরোনিমোস এ রায়ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘মঠের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও দখল করা হচ্ছে। অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্ম ও হেলেনিজমের (গ্রিক ধর্ম) এই আধ্যাত্মিক বাতিঘরের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।’

এক বিরল সাক্ষাৎকারে সেন্ট ক্যাথরিনের দীর্ঘদিনের আর্চবিশপ দামিয়ানোস গ্রিক একটি সংবাদপত্রকে বলেন, এই রায় তাঁদের জন্য ‘ভয়াবহ আঘাত এবং লজ্জার বিষয়’। এই ইস্যুতে তাঁর অবস্থান মঠের সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। এ কারণে, সম্প্রতি তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

জেরুজালেমের গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্কেট জানিয়েছে, পবিত্র এই স্থানের ধর্মীয় এখতিয়ার তাঁদের হাতে এবং এর জন্য নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজেই একটি সুরক্ষা চিঠি দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, বাইজেন্টাইন আমলের এই মঠের মধ্যে ফাতেমি যুগে নির্মিত একটি ছোট মসজিদও রয়েছে। এটি খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তির প্রতীক। এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।’

যদিও আদালতের বিতর্কিত রায় এখনো বহাল আছে। তবে, কূটনৈতিক তৎপরতার পর শেষ পর্যন্ত গ্রিস ও মিশর যৌথভাবে ঘোষণা দিয়েছে যে সেন্ট ক্যাথরিন মঠের গ্রিক অর্থোডক্স পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষিত রাখা হবে।

সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার
সম্প্রতি তিন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান সিনাই পর্বতকে একটি বৃহৎ পর্যটন প্রকল্পে পরিণত করছে মিসর। ছবি: বেন হফলার

পর্যটন খাতকে ঘিরে বড় ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে মিশর ২০২১ সালে শুরু করে গ্রেট ট্রান্সফিগারেশন প্রকল্প। এ পরিকল্পনায় নতুন হোটেল, ইকো-লজ, একটি বড় ভিজিটর সেন্টার, নিকটবর্তী ছোট বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং সিনাই পর্বতে উঠতে ক্যাবল কার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।

সরকার এই প্রকল্পকে প্রচার করছে ‘পুরো বিশ্ব ও সব ধর্মের জন্য মিশরের উপহার’ হিসেবে।

তবে অর্থসংকটের কারণে কাজ আপাতত কিছুটা থেমে আছে বলে ধারণা করা হলেও সেন্ট ক্যাথরিন মঠের সামনে আল-রাহা সমভূমি ইতিমধ্যেই পাল্টে গেছে। সেখানে নতুন রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। বলা হয়ে থাকে, আল্লাহর ডাকে নবী মুসা (আ.) যখন সিনাই পর্বতে ৪০ দিন অবস্থান করেছিলেন, তখন ইসরায়েলিরা এই স্থানেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। সমালোচকদের মতে, এই নির্মাণকাজে এলাকার বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে।

ইউনেসকো বলেছে, দুর্গম পাহাড়ি প্রাকৃতিক দৃশ্যপট মঠের জন্য এক অনন্য পটভূমি তৈরি করেছে। এখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিকতার এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ২০২৩ সালেই ইউনেসকো মিশরকে উন্নয়নকাজ থামানোর, প্রকল্পের প্রভাব যাচাই করার এবং সংরক্ষণ পরিকল্পনা করার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এখনো তা কার্যকর হয়নি।

গত জুলাইয়ে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ওয়াচ একটি খোলা চিঠি দিয়ে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটিকে অনুরোধ করে, সেন্ট ক্যাথেরিন এলাকাকে যেন বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ব্রিটেনের রাজা চার্লসের কাছেও আবেদন গেছে। তিনি সেন্ট ক্যাথেরিন ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক।

মিশরে বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা নতুন নয়। অনেক সময়ই অভিযোগ ওঠে—এসব পরিকল্পনায় দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীলতা দেখানো হয় না। তবে সরকারের দাবি, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে এমন প্রকল্পই সবচেয়ে জরুরি।

কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে যখন মিশরের পর্যটন খাত ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছিল, তখন গাজার যুদ্ধ আর নতুন করে তৈরি হওয়া আঞ্চলিক অস্থিরতা আবারও বড় আঘাত হানে। তবুও সরকার ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ কোটি পর্যটক টানার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে।

সিনাই উপদ্বীপে বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় বেদুইনদের মতামত না নিয়েই নানা উন্নয়ন কাজ চালানো হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে অঞ্চলটি ইসরায়েলের দখলে গিয়েছিল। ১৯৭৯ সালে শান্তিচুক্তির পর তা ফের মিশরের হাতে এলেও বেদুইনদের অভিযোগ—তাদের এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে মনে করে সরকার।

১৯৮০-এর দশকেই স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে লোহিত সাগরের তীরে শার্ম আল-শেখসহ নানা রিসোর্ট শহর গড়ে ওঠে।

হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে সেন্ট ক্যাথেরিন মঠ। শুরুর দিকে নির্জন স্থান থাকলেও লোহিত সাগরজুড়ে পর্যটন জমে উঠেছে। কেউ আসে মুসা (আ.) নবীর সঙ্গে আল্লাহর কথোপকথনের নিদর্শন সেই ‘জ্বলন্ত ঝোপ’-এর ধ্বংসাবশেষ দেখতে, কেউ দেখতে চায় কোডেক্স সিনাইটিকাস, যেটি নিউ টেস্টামেন্টের (খ্রিষ্টান বাইবেল) সর্বপ্রাচীন হাতে লেখা কপি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মধ্যরাতে কাদের সিদ্দিকীর বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর

চন্দ্রগ্রহণের সময় মুমিনের করণীয় আমল

বেতন চাইলে গৃহকর্মীদের পিস্তল দেখান সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শামসুদ্দোহা, ৯৯৯-এ কল পেয়ে গ্রেপ্তার

শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় থাইল্যান্ডের নজর শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশে

টাঙ্গাইলে মুখোমুখি কাদেরিয়া বাহিনী ও ছাত্র সমাবেশ, ১৪৪ ধারা জারি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত