Ajker Patrika

আমাজনের গহিনে অবৈধ খনিতে সোনার বিনিময়ে বিক্রি হয় যৌনতা

আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ২৬
নাতালিয়া কাভালকান্ত জানান তিনি যৌনকর্ম থেকে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। ছবি: বিবিসি
নাতালিয়া কাভালকান্ত জানান তিনি যৌনকর্ম থেকে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। ছবি: বিবিসি

দাইওনো লেইতো কখনো যৌনকর্মী হতে চাননি। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে স্বামী হার্ট অ্যাটাকে যখন মারা গেলেন, তখন তাঁর শেষকৃত্য চালানোর খরচও ছিল না। ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের পারা প্রদেশে অবস্থিত দাইওনোর শহর ইতাইতুবা দেশের অবৈধ সোনা খনিগুলোর কেন্দ্রবিন্দু। তাই একজন বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দেন আমাজনের গভীরে খনি শ্রমিকদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বিনিময়ে টাকা জোগাড় করতে।

‘খনিতে যাওয়া মানে একধরনের জুয়া খেলা।’ বলেন তিনি, ‘ওখানে নারীদের মারাত্মক অপমানিত হতে হয়। তাদের মুখে চড়-থাপ্পড় মারা হয় এবং গালমন্দ করা হয়।’

‘আমি আমার শোয়ার ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম, আর একজন লোক জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে আমার মাথায় বন্দুক ধরল। আর যদি টাকা দেয়, তবে তারা নারীদের নিজের সম্পত্তি মনে করে।’

দাইওনো সফলভাবে শেষকৃত্যের জন্য টাকা জোগাড় করেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তানের মা হন। গত ১৬ বছর ধরে ইতাইতুবার অনেক নারীর মতোই তিনি মাঝে মাঝে খনিতে গিয়ে রান্না, কাপড় ধোয়া, বারের কাজের পাশাপাশি করছেন যৌনকর্মীর কাজও।

এখন তিনি সাতজনের একটি পরিবার চালাচ্ছেন।

‘আমি বলব না এই শহরের সব নারী এটা করেন, কিন্তু অনেকেই কাজটি করেন। তাই এটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমরা এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না।’ বলেন নাতালিয়া কাভালকান্তে। তিনি ২৪ বছর বয়সে গভীর অরণ্যের একটি খনি এলাকায় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। চার বছর পর একটি বারের মালিককে বিয়ে করে তিনি একটি পতিতালয়ের পরিচালক হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি শহরে তাঁর ভাগনিদের দেখাশোনার জন্য তিনি এ কাজ ছেড়ে দেন।

আমাজনর জঙ্গলের আনুমানিক দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকা অবৈধ সোনার খনির দখলে আছে। ছবি: এএফপি
আমাজনর জঙ্গলের আনুমানিক দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকা অবৈধ সোনার খনির দখলে আছে। ছবি: এএফপি

এসব তথ্য জানা যায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

চিরসবুজ বা বৃষ্টি অরণ্যের খনি গ্রামগুলোতে জীবন খুবই কঠিন। বেশির ভাগ গ্রামে শুধু একটি কাঁচা রাস্তা, কিছু সেলুন, বার এবং একটি গির্জা থাকে। কিন্তু খনিশ্রমিকেরা আরও দূরে, কাঠ আর ত্রিপলের তৈরি ঘরে বাস করে। তাদের চারপাশে থাকে সাপ এবং জাগুয়ার। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে গোটা এলাকা নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে। রান্নার কাজ করা নারীদের এই শিবিরগুলোতেই পুরুষদের সঙ্গে বসবাস করতে হয়।

যখন খনিশ্রমিকেরা সোনা খুঁজে পান এবং টাকা আসে, তখন তাঁরা গ্রামে আসেন বলে নাতালিয়া জানান। অনেক সময় তাঁদের যৌন সম্পর্ক করার আগে গোসল করানোর জন্য রাজি করাতে হয়।

ব্রাজিলিয়ান আইনে পতিতালয় চালানো অবৈধ, তবে নাতালিয়া দাবি করেন, তিনি কোনো কমিশন নেননি। শুধু বারের স্টাফ নিয়োগ করতেন এবং কক্ষ ভাড়া দিতেন।

তরুণী নারীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন কাজের জন্য। তিনি মাঝে মাঝে তাঁদের ইতাইতুবা থেকে খনিতে ভ্রমণের জন্য টাকা ধার দিতেন। পাক্কা সাত ঘণ্টার যাত্রা এটি।

দাইওনো লেইতো ১২ বছর বয়স থেকে সোনার খনিতে কাজ করছেন। ছবি: বিবিসি
দাইওনো লেইতো ১২ বছর বয়স থেকে সোনার খনিতে কাজ করছেন। ছবি: বিবিসি

ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে, অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ মানুষ।

যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, অন্য নারীদের এই কাজে যুক্ত করা নিয়ে তাঁর কোনো দ্বিধা আছে কি না, তিনি জবাব দিলেন, ‘কখনো কখনো আমি ভাবি, নিজেও এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এবং আমি জানি এটি খুব ভালো কিছু নয়।’ কিন্তু তারপর আবার চিন্তা করি, ‘মেয়েটির একটি পরিবার আছে, কখনো কখনো একটি সন্তান লালন-পালন করতে হয়। যারা যায় তাদের অনেকেরই এক বা দুটি সন্তান থাকে। তাই আমরা এটা মেনে নিই।’

বিয়ে করার আগেই নাতালিয়া এভাবে অনেক টাকা উপার্জন করেছিলেন।

এখন তাঁর ইতাইতুবায় নিজের একটি বাড়ি, একটি মোটরসাইকেল এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সোনা আছে। এগুলো তিনি কখনো কখনো যৌনতার বিনিময়ে পেয়েছিলেন, একবারে দুই বা তিন গ্রাম করে। এখন তার লক্ষ্য পড়াশোনা করে একজন আইনজীবী বা স্থপতি হওয়া।

ইতাইতুবাকে অনেকেই ‘গোল্ড নাগেট সিটি’ নামে ডাকেন। এখানকার কিছু নারী এই কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন বলে জানান তিনি।

তবে, একজন নারী হিসেবে সহিংস এবং আইনহীন খনি এলাকায় পা বাড়ানোটা নিঃসন্দেহে বড় ঝুঁকির ব্যাপার।

ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: বিবিসি
ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: বিবিসি

খনিগুলোর পরিবেশগত ক্ষতি সবার জানা থাকলেও, জাতিসংঘ জানিয়েছে সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন এবং মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেদনভুক্ত হয় না।

মূল্যবান ধাতুর এক ব্যবসায়ী বিবিসিকে জানান, এই খনিগুলো থেকে আসা অবৈধ সোনা সাধারণত একটি লাইসেন্সধারী খনি সমবায়ের সোনা হিসেবে পুনরায় চিহ্নিত হয়, তারপর তা রপ্তানি করা হয় এবং গয়না, মোবাইল ফোনের অংশ বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ব্রাজিলের সোনার তিনটি বৃহত্তম ক্রেতা হলো কানাডা, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউটো এসকোলহাসের মতে, ইউরোপে রপ্তানি হওয়া সোনার ৯০ শতাংশের বেশি এমন এলাকা থেকে আসে, যেখানে অবৈধ খনন কার্যক্রম ঘটে।

খনি এলাকার গ্রামগুলোতে নারীদের হত্যার ঘটনাও ঘটে। গত বছর ২৬ বছর বয়সী রায়েলে সান্তোসের মৃতদেহ কুইউ-কুইউ সোনার খনির কাছে তাঁর থাকার ঘরে পাওয়া যায়। ইতাইতুবা থেকে ১১ ঘণ্টার দূরত্ব খনিটির।

রায়েলে সান্তোসকে একটি খনি এলাকার একটি গ্রামে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি
রায়েলে সান্তোসকে একটি খনি এলাকার একটি গ্রামে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি

রায়েলের বড় বোন রাইলানে জানান, এক ব্যক্তি তাকে যৌনতার বিনিময়ে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ওই ব্যক্তি তাঁকে খুঁজে বের করে পিটিয়ে হত্যা করেন।

রাইলানে বলেন, ‘আমি খনিতে জন্মেছি, খনিতে বড় হয়েছি, আর এখন আমি খনিতে থাকতে ভয় পাই।’

রায়েলের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে এখনো তাঁর বিচার হয়নি। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ব্রাজিলের অবৈধ সোনার খনির দখল করে থাকা এলাকার পরিমাণ ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে, যা গ্রেটার লন্ডনের চেয়েও বড়। এই এলাকায় কতজন নারী কাজ করেন, এমনকি কতজন অবৈধ খনি শ্রমিক আছেন, তা কেউ জানে না। ব্রাজিল সরকার বলছে, শ্রমিকের সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখের মধ্যে হতে পারে।

আমাজনের জঙ্গলের অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: এএফপি
আমাজনের জঙ্গলের অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দে সিলভার নেতৃত্বে সরকার অবৈধ খনি বন্ধ এবং তাঁদের উৎপাদিত সোনা কেনা বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সোনার উচ্চমূল্য এখনো অনেক পুরুষকে ভাগ্য পরীক্ষা করতে প্ররোচিত করছে।

দাইওনো লেইতো খনি এলাকায় কাজ করা বন্ধ করতে চান, কারণ ঝুঁকি ও কঠোর পরিশ্রম তাঁর শরীরকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে। তবে তিনি আশা করছেন, শেষবারের মতো সেখানে যাবেন। তাঁর লক্ষ্য হলো দুই বা তিন মাসে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করা, যাতে ফিরে এসে একটি স্ন্যাক বার খুলতে পারেন। যদিও তিনি জানেন, সফল না-ও হতে পারেন।

যখনই তিনি একা থাকেন, অরণ্যপথে হাঁটেন, তখন তার সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় বলে জানান।

‘সহ্যসীমা অতিক্রম করে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ বলেন তিনি, ‘কারণ আমি মনে করি, একদিন আমার সন্তানেরা বলবে, তাদের মা খুব পরিশ্রম করেছেন। যা সহ্য করেছেন, তাদের জন্য করেছে এবং কখনো হাল ছাড়েননি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ধীরে ধীরে চলছিল গাড়িটি, ট্রাফিক সিগন্যালে থামতেই বিকট বিস্ফোরণ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: পিটিআই
ছবি: পিটিআই

দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লা ভারতের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোর একটি। অন্যান্য দিনের মতো আজকেও অসংখ্য মানুষের ভিড় ছিল লালকেল্লার সামনে।

সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিট। লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ১ নম্বর গেটের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে আছে অনেক গাড়ি। কিন্তু ছোট একটি গাড়ি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। ওই গাড়িতেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ।

সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

দিল্লি পুলিশ কমিশনার সত্যেশ গোলচা সাংবাদিকদের জানান, বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের বেশ কয়েকটি গাড়ি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ভাঙাচুড়া গাড়ি, ছিন্নভিন্ন লাশ এবং রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে আছে কাচের টুকরা।

গোলচা আরও জানান, ফরেনসিক দল, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি) ঘটনাস্থলে তদন্ত শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন এবং তাঁকে প্রতিনিয়ত আপডেট জানানো হচ্ছে।’

দিল্লি ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি চিফ এ কে মালিক সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, বিস্ফোরণের পর যে আগুন লেগেছিল, তা সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল।

ফায়ার সার্ভিসের আরও এক কর্মকর্তা পিটিআইকে জানান, আগুনে ছয়টি গাড়ি, দুটি ই-রিকশা ও একটি অটোরিকশা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।

ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৮০০ মিটার দূরে অবস্থিত চাঁদনি চক ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সঞ্জয় ভরগবের দোকান। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের শব্দে পুরো ভবন কেঁপে উঠেছিল।

আরও এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আমি গুরুদুয়ারায় ছিলাম, হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ শুনি। শব্দটা এতটাই জোরে ছিল, আমি বুঝতেই পারিনি কী ঘটেছে।’

এ ঘটনার পর দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কাশ্মীরের চিকিৎসক জঙ্গি সংগঠন জইশের সদস্য, হরিয়ানার তাঁর বাসায় মিলল ৩ টন বিস্ফোরক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ৪১
জইশ-ই-মোহাম্মদের সদস্য কাশ্মীরের চিকিৎসক মুজাম্মিল শাকিল। ছবি: সংগৃহীত
জইশ-ই-মোহাম্মদের সদস্য কাশ্মীরের চিকিৎসক মুজাম্মিল শাকিল। ছবি: সংগৃহীত

হরিয়ানার ফরিদাবাদে এক চিকিৎসকের ভাড়া নেওয়া দুই বাড়ি থেকে ২ হাজার ৯০০ কেজির বেশি (প্রায় ৩ টন) বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামার বাসিন্দা চিকিৎসক মুজাম্মিল শাকিল। তিনি ভারতে প্রথম শ্রেণির পেশাজীবীদের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত করতেন।

প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, উদ্ধার করা পদার্থগুলো সম্ভবত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, যা সাধারণত বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফরিদাবাদ ও জম্মু–কাশ্মীর পুলিশ সকাল থেকে ওই বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে।

শাকিল ফরিদাবাদের আল-ফালাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। দিল্লি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে ধোজ এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনপ্রাপ্ত।

গতকাল রোববার পুলিশ ধোজ এলাকার তাঁর ভাড়া নেওয়া বাড়ি থেকে ৩৫০ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ২০টি টাইমার, অ্যাসল্ট রাইফেল, হ্যান্ডগান ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। শাকিল সেখানে সাড়ে তিন বছর ধরে থাকতেন। জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রমাণ মেলায় ১০ দিন আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অভিযানে আরও একটি পিস্তল, আটটি গুলি, দুটি খালি কার্তুজ, দুটি অতিরিক্ত ম্যাগাজিন, আটটি বড় স্যুটকেস, চারটি ছোট স্যুটকেস ও একটি বালতি উদ্ধার করা হয়।

হরিয়ানায় মুজাম্মিল শাকিলের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার অস্ত্র ও গুলি। ছবি: সংগৃহীত
হরিয়ানায় মুজাম্মিল শাকিলের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার অস্ত্র ও গুলি। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় বাড়িটি ধোজ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ফতেহপুর টাগা গ্রামে। ওই বাড়ির মালিক এক মাওলানা, যাকে ইতিমধ্যে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ অভিযানে সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগর, আনন্তনাগ, গান্ডারবাল, শোপিয়ানসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং ফরিদাবাদে একাধিক স্থানে তল্লাশিতে এক নতুন ধরনের ‘প্রথম শ্রেণির পেশাজীবীদের জঙ্গি নেটওয়ার্ক’ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। যেখানে বহু শিক্ষিত ও পেশাজীবী, বিশেষত চিকিৎসক যুক্ত রয়েছেন। গত ১৫ দিনের এই যৌথ অভিযানে ২ হাজার ৯০০ কেজির বেশি বোমা তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে।

এর আগেও উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে কর্মরত কাশ্মীরি চিকিৎসক ড. আদিল আহমদ রাঠেরকে শ্রীনগরে জইশ-ই-মোহাম্মদ সমর্থনকারী পোস্টার লাগানোর অভিযোগে আটক করা হয়।

শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ফরিদাবাদ পুলিশ তাঁর এক নারী সহকর্মীর সুইফট গাড়ি উদ্ধার করে, যেখানে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ও একটি পিস্তল পাওয়া যায়। ওই নারী চিকিৎসককেও পরে গ্রেপ্তার করা হয়।

গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই পেশাজীবী জঙ্গি চক্রটি পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাঁরা শুধু প্রচারমূলক পোস্টার লাগানোই নয়, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায়ও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

শাকিল ও রাঠের ছাড়াও আরিফ নিসার দার, ইয়াসির উল আশরাফ, মাকসুদ আহমদ দার (শ্রীনগর), মৌলভি ইরফান আহমদ (শোপিয়ান), জমির আহমদ আহাঙ্গারকেও (গান্ডারবাল) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অস্ত্র ও বিস্ফোরকসামগ্রীর পাশাপাশি পুলিশ ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরির নির্দেশনা-সংবলিত বই ও নথিপত্রও উদ্ধার করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দিল্লি বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগে হরিয়ানায় ৩ টন বিস্ফোরক উদ্ধার, কিসের ইঙ্গিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ৩৭
দিল্লি বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগে হরিয়ানায় ৩ টন বিস্ফোরক উদ্ধার, কিসের ইঙ্গিত

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে রেড ফোর্টের পাশে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত আটজন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছেন। আজ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ১ নম্বর গেটের বাইরে গাড়িতে এই বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থল ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ত ও নিরাপত্তা সংবেদনশীল এলাকায় হওয়ায় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, বিস্ফোরণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে আশপাশের একাধিক গাড়িতে আগুন ধরে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি ভ্যানের দরজা উড়ে গেছে এবং একটি গাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল দেহের খণ্ডাংশ।

প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের ধরন বা উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত শুরু করেছে। দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।

দিল্লি, মুম্বাই, জয়পুর, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় দুই ডজন অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে এবং এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। ফরেনসিক ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল আলামত সংগ্রহ করছে।

ফরিদাবাদে বিস্ফোরক উদ্ধারের পরই দিল্লিতে বিস্ফোরণ

বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগে হরিয়ানার ফরিদাবাদে দুটি আবাসিক ভবন থেকে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কেজি (৩ টন) বিস্ফোরক উদ্ধার করে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ। এর মধ্যে ৩৫০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল, যা সার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রাণঘাতী বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে।

এই অভিযান পরিচালিত হয় জম্মু ও কাশ্মীরের এক চিকিৎসক আদিল রশিদ রাঠারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। সিসিটিভিতে জইশ-ই-মোহাম্মদ নামের সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থনে পোস্টার লাগাতে দেখে রাঠারকে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পোস্টারগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হুমকি ছিল বলে পুলিশের দাবি।

তদন্তে মুজাম্মিল শাকিল নামের আরও একজন চিকিৎসকের নাম উঠে আসে। তিনি ফরিদাবাদের আল-ফালাহ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাঁর নামে থাকা দুটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ১২টি স্যুটকেসভর্তি বিস্ফোরক, ডেটোনেটর ও টাইমার ডিভাইস উদ্ধার করে।

এ ছাড়া এক নারী চিকিৎসককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার গাড়িতে একটি রাইফেল ও গুলি পাওয়া গেছে। আরও একটি রাইফেল উদ্ধার হয় কাশ্মীরের আনন্তনাগের মেডিকেল কলেজের একটি লকার থেকে, যেখানে আদিল রাঠার গত বছর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের ইঙ্গিত

এ ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ ও আল-কায়েদা সম্পৃক্ত আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ জড়িত বলে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের দাবি। অভিযানের মাধ্যমে তারা এই দুটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত একটি আন্তরাজ্য ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়েছে।

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আদিল রাঠার, মুজাম্মিল শাকিল, নারী চিকিৎসকসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ফরিদাবাদে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও কয়েক ঘণ্টা পর দিল্লির হৃদয়স্থলে হওয়া এই বিস্ফোরণ—দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রাজধানীতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা ছিল, যা আংশিকভাবে সফল হয়েছে।

ঘটনার পর পুরো দিল্লিতে রেড অ্যালার্ট ঘোষণা করা হয়েছে এবং লালকেল্লা এলাকা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এই বিস্ফোরণ সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হামলার ইঙ্গিত বহন করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ছিন্নভিন্ন শরীর, হাত পড়ে আছে রাস্তায়—প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় দিল্লি বিস্ফোরণের বীভৎসতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ১৭
বিস্ফোরণের কারণ এখনো জানা যায়নি। ছবি: পিটিআই
বিস্ফোরণের কারণ এখনো জানা যায়নি। ছবি: পিটিআই

দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লার কাছে একটি গাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত আটজন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর মানুষের দেহের অংশ উড়ে এসে তাঁর সামনে রাস্তায় পড়তে দেখেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই ব্যক্তি কাঁপা কণ্ঠে বলেন, বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই প্রবল ছিল যে ‘কান কয়েক মিনিট ধরে বাজতে থাকে’। তিনি বলেন, ‘একজনের শরীর টুকরা হয়ে গিয়েছিল। আমি রাস্তায় একটি হাত পড়ে থাকতে দেখেছি। এটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, বিস্ফোরণটা ছিল ভয়ংকর।’

আরও একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিস্ফোরণের শব্দে আশপাশের ভবন, জানালা ও দরজা কেঁপে ওঠে।

আজ সোমবার লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের এক নম্বর গেটের বাইরে বিস্ফোরণটি ঘটে। সেখানে সব সময় পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে। ঘটনাস্থলটি জামা মসজিদ থেকে মাত্র ১ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরে এবং গুরুদুয়ারা সিসগঞ্জ সাহিব থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে।

ঘটনার পরপর অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, গাড়িগুলো সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ধ্বংসাবশেষ ও দগ্ধ দেহাবশেষ। ডজনখানেক অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজ শুরু করে।

এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমি আমার বাড়ির ছাদ থেকে এক বিশাল আগুনের গোলা দেখেছি। মুহূর্তেই ভয়ংকর শব্দে সবকিছু কেঁপে ওঠে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে যাই। আমার বাড়ি গুরুদুয়ারার কাছে।’

আরও একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘সবকিছু হঠাৎ করেই ঘটল। আমার মনে হলো, শুধু একটি গাড়ি নয়, একাধিক গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছে।’

বিস্ফোরণের কারণ এখনো জানা যায়নি। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন এবং বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত