Ajker Patrika

ভাই-বোনের স্নেহচুম্বন ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী, বিজেপি মন্ত্রীদের মন্তব্যে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সৌহার্দ্য বিনিময়কে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলছেন বিজেপি নেতারা। ছবি: সংগৃহীত
রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সৌহার্দ্য বিনিময়কে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলছেন বিজেপি নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

ভাই-বোনের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তিকর ও কুরুচিকর মন্তব্য করে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের নগর উন্নয়ন মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রর জনসমক্ষে সৌহার্দ্য বিনিময়ের (আলিঙ্গন ও মাথায় স্নেহচুম্বন) প্রসঙ্গ টেনে তিনি এটিকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর এই বক্তব্য দ্রুতই একটি রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিয়েছে।

মধ্যপ্রদেশের শাজাপুর জেলায় একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে কৈলাস বিজয়বর্গীয় রাহুল গান্ধীকে সরাসরি আক্রমণ করেন। তিনি ভারতীয় মূল্যবোধ এবং বিদেশি সংস্কৃতির তুলনা টেনে বলেন: ‘আমার বাবা পুরোনোপন্থী লোক। আমরা আমাদের বোনের গ্রামে জল পর্যন্ত খাই না (গুরুত্ব ও সম্মান বোঝাতে)। কিন্তু আমাদের বিরোধী নেতারা এমন যে খোলা রাস্তায় ওরা নিজেদের বোনকে চুমু খায়। আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের মধ্যে কেউ নিজের যুবতী বোনকে চুমু খান? আসলেই শিক্ষা আর সংস্কারের অভাব। এসব বিদেশি সংস্কৃতি।’

তিনি আরও দাবি করেন, এই ‘বিদেশি সংস্কৃতি’ আমদানির কারণেই রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও ‘রূঢ়ভাবে’ কথা বলেন, ‘তুই-তোকারি’ করেন।

পরে এক সংবাদমাধ্যমকে বিজয়বর্গীয় অবশ্য কিছুটা নরম হয়ে বলেন, এতে রাহুলের বিশেষ দোষ নেই, কারণ ‘উনি বিদেশে বড় হয়েছেন’ এবং ‘বিদেশি সংস্কৃতি আমদানি করেছেন’।

কৈলাস বিজয়বর্গীয়র বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে যখন উত্তাপ বাড়ছে, তখন তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মী বিজয় শাহ প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন করে বিতর্কে ঘি ঢেলেছেন। খান্ডওয়াতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিজয় শাহ জোর দিয়ে বলেন, ‘এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়; আমাদের সভ্যতা, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য এসব শেখায় না। তারা যা শেখায়, তা নিজেদের বাড়িতে অনুশীলন করুক, জনসমক্ষে নয়।’

বিজয় শাহ মঞ্চে উপস্থিত নারী বিধায়ক কাঞ্চন তানভের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘উনিও আমার আপন বোন, তাহলে কি আমি জনসমক্ষে তাঁকে চুমু খাব? ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সভ্যতা এটা শেখায় না।’

বিজয় শাহের এই সমর্থন বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অতীতেও আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালের ১৩ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে মন্তব্য করে তিনি চরম বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। অবশ্য পরে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ঈশ্বর নই, আমি একজন মানুষ, এবং যদি কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তবে আমি দশবার ক্ষমা চাই।’ বিজয় শাহ বলেছিলেন, ‘যারা আমাদের মা-মেয়ের সিঁদুর মুছে দিয়েছে, তাদের বোনকেই ব্যবহার করে হামলাকারীদের শায়েস্তা করেছি। ওরা (জঙ্গিরা) পোশাক খুলিয়ে বেছে বেছে হিন্দুদের মেরেছে। আর মোদীজি ওদের বোনকে দিয়েই উচিত শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন। মোদীজি তো আর ওদের মতো ব্যবহার করতে পারেন না। তাই ওদের সম্প্রদায়ের বোনকে দিয়েই ওদের বারোটা বাজিয়েছেন।’

উল্লেখ্য, ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। অভিযানের পর যাঁরা সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে ভারতীয় সেনার কৃতিত্ব তুলে ধরছিলেন জনসমক্ষে, তাঁদের মধ্যেও অন্যতম। ভারতীয় সেনার সেই কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে ‘সন্ত্রাসবাসীদের বোন’ বলে মন্তব্য করেন বিজয় শাহ।

রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সৌহার্দ্য বিনিময় নিয়ে বিজেপি মন্ত্রীদের মন্তব্যে ফুঁসে উঠেছে কংগ্রেস। তারা এই মন্তব্যকে ‘ভাই-বোনের শ্রদ্ধার সম্পর্ককে কলুষিত করার চেষ্টা’ বলে অভিহিত করে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেছে এবং কৈলাস বিজয়বর্গীয়র কুশপুতুল পুড়িয়েছে।

মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি জিতু পাটওয়ারি এই মন্তব্যকে ‘কুরুচিকর’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘কৈলাসজি নবরাত্রীর পবিত্র সময়কেই বেছে নিলেন ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ককে কলুষিত করতে। ওঁর ভাষা সবাই জানে...এই সব মন্তব্যের জবাব দিতেও লজ্জা লাগে।’ পাটওয়ারি আরও গুরুতর অভিযোগ করে বলেন, ৭০ বছর বয়সেও কৈলাস বিজয়বর্গীয় মুখ্যমন্ত্রী হতে না পারার হতাশায় ‘অযৌক্তিক মন্তব্য’ করছেন এবং ‘আমাদের সংস্কৃতি ও নারীদের অপমান করছেন।’ তিনি দুই মন্ত্রীরই পদত্যাগ দাবি করেন।

কংগ্রেস মুখপাত্র কে কে মিশ্র মন্তব্য করেছেন, যেসব বিজেপি মন্ত্রী অশ্লীল এবং কুরুচিকর ভাষা ব্যবহার করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া দুর্ভাগ্যজনক।

তুমুল সমালোচনার মুখে কৈলাস বিজয়বর্গীয় গতকাল শুক্রবার তার বক্তব্যের পক্ষেই সাফাই দেন। ভোপালে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, তিনি কোনো সম্পর্কের পবিত্রতাকে প্রশ্ন করছেন না, বরং বিদেশি এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য নিয়ে কথা বলেছেন।

বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘...আমি কোনো সম্পর্কের পবিত্রতাকে প্রশ্ন করছি না। সব সম্পর্কই পবিত্র। তবে একটি সীমা রয়েছে, এবং আমি সেই সীমাটির কথাই বলছি। আমি শুধু বিদেশি সংস্কৃতি আর ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেছি। আপনারা যদি আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য শুনতেন, তবে এই প্রশ্ন উঠত না।’

তবে, বিজয় শাহের মতো জ্যেষ্ঠ নেতার সমর্থন পাওয়ায় এই বিতর্ক এখন চরম আকার ধারণ করেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, দুই মন্ত্রীই রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে গিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে বিকৃত করছেন, যা নারী মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত