Ajker Patrika

ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে প্রতিবছর

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ঢাকা শহরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ায় জাতীয়ভাবেই তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই বাড়ছে রোগী অনুপাতে মৃত্যুহার বা কেস ফ্যাটালিটি রেট (সিএফআর)। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেও রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা মন্তব্য করেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশে একটি রোগে মৃত্যুর হার না কমলে তা রোগী ও রোগ ব্যবস্থাপনার ঘাটতিকেই নির্দেশ করে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু একসময় দূরের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের রোগ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বিক্ষিপ্ত কিছু নমুনার পর আড়াই যুগ আগে, ২০০০ সালে দেশে কিছুটা বড় ধরনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সচকিত হয় সরকার। সরকারি তথ্য বলছে, সে বছর থেকেই প্রথম ডেঙ্গুর নিয়মিত পরিসংখ্যান রাখতে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশে রোগতত্ত্বের পর্যালোচনায় গুরুত্ব পেতে থাকে রোগটি। ক্রমে প্রকোপ হ্রাস পেয়ে দেশ কয়েক বছর ডেঙ্গুহীন ছিল। তবে পরে আবার ফিরে আসে। সব মিলিয়ে শুরু থেকে বিগত সিকি শতাব্দী সময়ে ডেঙ্গু ধীরে ধীরে দৃশ্যত দেশের স্বাস্থ্য খাতের স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

দেশে বিভিন্ন সময় ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যুর সংখ্যার ওঠানামা হয়েছে। প্রথম দিকে মূলত ঢাকা মহানগরে সীমিত থাকলেও ২০১৯ সালে এসে অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু। ২০১৯ সালে ১ লাখের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে দেড় শর বেশি মারা যায়।

২০০০ থেকে ২০২২ সাল—এ ২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। এর মধ্যে মারা গেছে ৮৫০ রোগী। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল সর্বোচ্চ। ওই বছর হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছর ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন রোগীর বিপরীতে মারা যায় ৫৭৫ জন। আর চলতি বছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা দেশে ৬ হাজার ৯২৬ জন রোগীর বিপরীতে মারা গেছে ৩০ জন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (ইসিডিসি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী এলসেভিয়ারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে বিশ্বে বাংলাদেশেই মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দেশটিতে গত বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। এরপর যথাক্রমে বেশি রোগী শনাক্ত হয় দক্ষিণ আমেরিকারই দেশ বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনায়। তবে ওই দেশগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুহার বেশি বাংলাদেশে। গত বছর রোগীর অনুপাতে ব্রাজিলে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশে তা ছিল শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, বাংলাদেশে রোগীর অনুপাতে মৃত্যুর হার প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। ২০১৮ সালে দেশে রোগীর অনুপাতে মৃত্যুহার ছিল দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা হয় শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০২১ সালে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর চলতি বছরের সাড়ে ছয় মাসে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ।

দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হারের কারণে আশঙ্কা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ববিদেরা। তাঁরা বলছেন, কোনো দেশে ডেঙ্গুর মতো সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ক্রমে না কমলে তা রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হয়। শুরু থেকেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার প্রায় একই ধারায় দেখা গেছে। বিশ্বে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যায় বাংলাদেশ অনেক দেশের নিচে। তবে মৃত্যুহার শীর্ষে।

জাতীয় প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে রোগী অনুপাতে মৃত্যুর বিদ্যমান হার নির্দেশ করে রোগী ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে না। রোগীর সংখ্যা যা-ই হোক, মৃত্যুহার না কমলে সন্তুষ্টির কিছু নেই। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি রয়েছে। ভবিষ্যতে রোগী কত হবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে মৃত্যুহার হ্রাসের লক্ষণ নেই।’

রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেনের মতে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে রোগের ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে। শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের নিয়েই ডেঙ্গুসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করলে চলবে না। ডেঙ্গুর বিষয়ে যেসব সার্ভে হয়, তা শুধু একটা জরিপ। রোগ, রোগী ও কীটনাশকের সার্ভিল্যান্স (বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা) থাকতে হবে। এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এসব করতে পারলে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূলে ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জনস্বাস্থ্যের চিন্তাভাবনা উপেক্ষিত। শুরু থেকেই সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ স্থানীয় সরকার বিভাগের। তারা এ কাজ যথাযথভাবে করছে না। এডিস নির্মূলে ধোঁয়া ছড়ানো (ফগিং) ছাড়া তাদের অন্য কোনো কার্যক্রম তেমন দেখা যায় না।

পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর তথ্য শুধু কয়েকটি হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে রোগীর হিসাব নেই। ডেঙ্গুর জন্য যে পর্যায়ে রোগীর সার্ভিল্যান্স প্রয়োজন, তা নেই। রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে, ফলে রোগী কমানোর জন্য প্রচেষ্টা থাকতে হবে। একই সঙ্গে রোগী বাড়লেও মৃত্যু যেন না বাড়ে তার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি থাকতে হবে। সর্বোপরি জনগণের সম্পৃক্ততা এবং সচেতনতা না বাড়লে ডেঙ্গু সামাজিকভাবে শেষ করা যাবে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশিদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর চিকিৎসায় নির্দেশিকা তৈরি করেছে। সময়ে সময়ে তা সংশোধন ও হালনাগাদ করা হয়। সে অনুযায়ী চিকিৎসক-নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’

ডেঙ্গু রোগী এবং রোগের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যেটা হয় না সেটা নিয়ে আমি নতুন কী বলব! রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। বর্তমানে বরগুনায় রোগী সবচেয়ে বেশি। সেখানে আইইডিসিআর থেকে টিম পাঠানো হয়েছে। তারা দেখবে কী কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে ফাঁস দিলেন স্ত্রী

ইরানে ভূমিকম্প নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জল্পনা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘আমেরিকা যুদ্ধে জড়ালে ইরানের হাতে অনেক বিকল্প আছে’

‘ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় নয়, গুণে বিশ্বাসী ইরান, ইসরায়েল এবার আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখবে’

আরেকটি ‘সাইকস-পিকট তন্ত্র’ মানব না, কিসের হুঁশিয়ারি দিলেন এরদোয়ান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত