Ajker Patrika

বিনা রোগে মৃত্যুর ৫৪ শতাংশই অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যায়

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ১১
বিনা রোগে মৃত্যুর ৫৪ শতাংশই অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যায়
প্রতীকী ছবি

দেশে প্রতিদিন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। কারও আঘাত মৃদু, কারও মাঝারি, আবার কারও আঘাত মারাত্মক হয়। মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০০ জন আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন, আর মারা যান আড়াই শতাধিক। আঘাতের কারণে যাঁরা মারা যান তাঁদের অর্ধেকেরই মৃত্যুর কারণ তিনটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আর তা হলো আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং পড়ে গিয়ে মৃত্যু।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘প্রিভেলেন্স অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস ফর মর্টালিটি অ্যান্ড মোরবিডিটি ইন রিলেশন টু ন্যাশনাল হেলথ ইনজুরি সার্ভে অব বাংলাদেশ ২০২২-২৩’ শিরোনামে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

গবেষণায় যেসব অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা উঠে এসেছে, তা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান থাকলেও এসব সমস্যা রোধে প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ফলে এসব সমস্যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ যেমন সৃষ্টি করছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যয়। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ চিরতরে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন এসব কারণে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সে হিসাবে দৈনিক ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ আঘাত পান। মারাত্মক আঘাতে বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যান। অর্থাৎ দৈনিক মারা যান গড়ে ২৬৮ জন। একইভাবে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি এবং দৈনিক ৩৮০ জন আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন।

মারাত্মক আঘাতে প্রাণ হারানোদের মধ্যে প্রতিবছর সাড়ে ২০ হাজারই আত্মহত্যার কারণে মারা যান, যার দৈনিক গড় ৫৬ জন। এ ছাড়া পানিতে ডুবে মারা যান বছরে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, দৈনিক গড়ে ৫০ জন। গাছ বা অন্যান্য উঁচু স্থান থেকে পড়ে বছরে সোয়া ১৪ হাজার এবং দিনে গড়ে ৩৯ জন মানুষ মারা যান। এ ছাড়া যন্ত্রপাতির আঘাত, ধারালো বস্তুতে কেটে যাওয়া, দুর্ঘটনার কারণে শ্বাসরোধ, দগ্ধ হওয়া, ভোঁতা বস্তুর আঘাত, প্রাণী বা কীটপতঙ্গের কামড়, সহিংসতা, বিদ্যুতায়িত হওয়া এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে এই ১২ ধরনের আঘাতের কারণে দেশে প্রতিবছর মোট ৯৮ হাজার ৪২২ জন মানুষ মারা যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিআইপিআরবির গবেষণায় উঠে আসা যে বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো তা হলো, আঘাতের কারণে দৈনিক মোট মৃত্যুর ৫৪ শতাংশেরই কারণ আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে যাওয়া এবং উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া। এই তিন কারণে সৃষ্ট আঘাতে দিনে গড়ে ১৪৫ জন মানুষ মারা যান। এসব বিষয়কে অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আন্তর্জাতিক ও দেশীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং পড়ে যাওয়া—এই তিনটি স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। তবে গবেষণা, নীতি ও অর্থায়নে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এগুলোকে অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া থেলাসেমিয়া, কুষ্ঠরোগ, সাপের দংশনসহ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগকেও এভাবে বিবেচনা করা হয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘অসংক্রামক রোগ ও অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যু, আত্মহত্যা ইত্যাদির মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছে। এসব সমস্যায় প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এখনো সীমিত। এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ চলছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে।’

ডব্লিউএইচওর ২০১০, ২০২১ ও ২০২৩ সালের তিনটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সমস্যা এখনো অবহেলিত রয়ে গেছে। সংস্থাটির ভাষায়, অবহেলাজনিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলো এমন সমস্যা, যা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু বৈশ্বিক ও জাতীয় নীতি, গবেষণা, অর্থায়ন কিংবা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। অনেক সময় এসব সমস্যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আলোচনায়ও স্থান পায় না। আক্রান্ত জনগোষ্ঠী সাধারণত দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির হওয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শোনা যায় না। তা ছাড়া সামাজিক কলঙ্ক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আত্মহত্যায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর সোয়া ৭ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এটি ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। তবে সামাজিক কলঙ্ক, আইনি জটিলতার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও নীতি-উদ্যোগ সীমিত থেকে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, পানিতে ডুবে মৃত্যু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতিবছর এ কারণে মারা যান ৩ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণও এটি। সাঁতার শেখানো কিংবা পানিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মতো কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নীতি পর্যায়ে এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। একইভাবে উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া বা ফ্যালস বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অনিচ্ছাকৃত আঘাতই মৃত্যুর কারণ। প্রতিবছর ৬ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ এ ধরনের আঘাতে প্রাণ হারান। বিশেষত বয়স্কদের জন্য এটি বড় ঝুঁকি হলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও বিনিয়োগ এখনো সীমিত।

আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বড়সংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষাধিক মানুষ আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়াটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, ‘অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে দেশে কাজ কম। এ বিষয়ে রেফারেন্স বা প্রমাণও সীমিত। ফলে সরকারের মনোযোগও কম। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন খরচসাপেক্ষ এবং ফলও দ্রুত পাওয়া যায় না, তাই অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মূলত চিকিৎসাকেন্দ্রিক। যাঁরা আঘাতপ্রাপ্ত বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ। ফলে তাঁদের সমস্যাকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না।’

সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, আঘাতজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা কমলেও, আত্মহত্যা বেড়েছে। এসব সমস্যা ‘অবহেলিত’ হিসেবে ধরা হয়, কারণ এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা বা কার্যক্রম নেই। তিনি বলেন, ‘সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে তা হয়নি। ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রধানত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এসব আঘাত এবং মৃত্যু প্রায় অদৃশ্য বা ‘ইনভিজিবল ইনজুরি অ্যান্ড ডেথ’ হিসেবে রয়ে যাচ্ছে।’

ওই গবেষণাটিতে বহুধাপী ক্লাস্টার নমুনা গ্রহণ পদ্ধতি (মাল্টিস্টেজ ক্লাস্টার স্যাম্পলিং) ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রামীণ ও শহরভিত্তিক স্তরীকরণ করা হয় এবং দেশের সব ৬৪ জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। জরিপে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক সদ্য উন্নত প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মোট ৪ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি মানুষের (প্রায় সোয়া এক লাখ পরিবার) তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ মানুষ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে যান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায় ১৫ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালে ৯ শতাংশ, জেলা হাসপাতালে ৯ শতাংশ, চিকিৎসকের চেম্বারে ৬ শতাংশ, বিশেষায়িত হাসপাতালে ৪ শতাংশ। কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে যায় মাত্র ১ শতাংশ।

পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেকট) অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া নেগলেকটেড পাবলিক হেলথ ইস্যু, কারণ এগুলো সাধারণ মৃত্যুর তুলনায় ব্যতিক্রম এবং যথেষ্ট আলোচনায় আসে না। তথ্যও সঠিকভাবে রিপোর্ট হয় না। গবেষণার ফলে আমরা জানতে পেরেছি কত মানুষ আহত, পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা মারা যান। এখন এই গবেষণার ফল ব্যবহার করে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত