Ajker Patrika

তানজানিয়ার ভয়ংকর হ্রদ, পড়লে সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে যায় প্রাণী?

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬: ৩৩
তানজানিয়ার ভয়ংকর হ্রদ, পড়লে সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে যায় প্রাণী?

দেশ তানজানিয়ার ন্যাট্রন হ্রদ, যেখানে কোনো প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায়। আফ্রিকার সবচেয়ে নির্মল হ্রদগুলোর মধ্যে একটি। এই হ্রদের পানির সংস্পর্শে আসলে যে কোনো প্রাণীর চামড়া পুড়ে যায় এবং তারা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে তাদের দেহ সেখানে থাকার কারণে তা পাথরে পরিণত হয়। এর সৌন্দর্যের কারণে প্রতিবছর অনেক অতিথি পাখি এখানে আসে। দুর্ঘটনাবশত এদের অনেকেই মারা যায়।

ফেসবুকে এমন তথ্য সংবলিত পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্টে একটি হ্রদ ও পানির ওপর একটি মৃত পাখির ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

‘বিজ্ঞান পোস্ট: (মহাকাশ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি)’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এমন একটি পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টটি আজ শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা পর্যন্ত ১ হাজার শেয়ার হয়েছে। এতে রিয়েকশন পড়েছে প্রায় ১৪ হাজার।

পোস্টটিতে ন্যাট্রন হ্রদটি নিয়ে বলা হয়েছে, ন্যাট্রন হ্রদের ক্ষারীয় জলের পিএইচ মান ১০ দশমিক ৫ এর মতো। এর তীব্র ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য প্রাণীদের ত্বক এবং চোখ পুড়িয়ে ফেলতে পারে। পানির ক্ষারত্ব আসে সোডিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য খনিজ থেকে। পার্শ্ববর্তী আগ্নেয়গিরির লাভার কারণেই হ্রদের পানি এতো ক্ষারীয়। পানিতে অতিরিক্ত সোডিয়াম কার্বনেট থাকার কারণে মৃতদেহগুলো পচে না।

ন্যাট্রন হ্রদের পানি কি বিপজ্জনক?
হ্রদটি নিয়ে অনুসন্ধানে বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সে ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যগুলোর মিল পাওয়া যায়। তানজানিয়ায় অবস্থিত ন্যাট্রন হ্রদ আফ্রিকার সবচেয়ে শান্ত হ্রদগুলোর একটি। হ্রদটি আফ্রিকার সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ওল ডোইনিও লেংগাইয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই হ্রদ থেকে এমন কিছু ছবি তোলা হয়েছে, যা দেখলে মনে হয়, জীবন্ত প্রাণীগুলো যেন সহসায় পাথরে পরিণত হয়েছে!

হ্রদটির পানিতে সোডিয়াম কার্বনেটের পরিমাণ অনেক বেশি। এটি মিশরে মমি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। হ্রদটির পানিতে পড়ে মারা যাওয়া প্রাণী দেহের পচন রোধে এই সোডিয়াম কার্বনেট চমৎকার প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করে। 

উল্লেখ্য, ১০ অণু পানিযুক্ত সোডিয়াম কার্বোনেট লবণকে রসায়ন বিজ্ঞানে ন্যাট্রন বলে। এর রাসায়নিক সংকেত— Na2(CO3)10(H2O)।

হ্রদটি সম্পর্কে লাইভ সায়েন্সে বলা হয়েছে, কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয়, কোনো প্রাণী এই হ্রদের পানির সংস্পর্শে এলেই সেটি মারা যায় এবং পাথরে পরিণত হয়। দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ন্যাট্রন হ্রদের ক্ষারীয় পানিতে তেলাপিয়া এবং শৈবালের একটি সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এই বাস্তুতন্ত্রকে কেন্দ্র করে সেখানকার ফ্ল্যামিঙ্গো পাখিরা জীবন নির্বাহ করে। 

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক ম্যাগি কোয়ের্থ–বেকারকে উদ্ধৃত করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, ন্যাট্রন হ্রদটিকে ভয়ংকর হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও এটি অত ভয়ংকর নয়। হ্রদটির ক্ষারীয় পানিতে তেলাপিয়া জাতীয় মাছ ও শৈবাল পাওয়া যায়। এই মাছ ও শৈবাল হ্রদটির ক্ষারীয় পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, হ্রদটি লেজার ফ্ল্যামিঙ্গো পাখিদের গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্র। হ্রদটিতে কোনো প্রাণী পড়লেই তৎক্ষণাৎ মারা যায় না এবং মৃত প্রাণী পাথরেও পরিণত হয় না। যে প্রাণীগুলো এখানে মারা যায়, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানির কারণে সেগুলোর দেহাবশেষ পচে না, দীর্ঘদিন অক্ষত থাকে। এগুলোই হ্রদটিকে অনন্য করে তুলেছে। 

এই হ্রদে ঘুরে এসে ‘অ্যাক্রোস দ্য রাভাগেইড ল্যান্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের আলোকচিত্রী নিক ব্র্যান্ডট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে প্রাণীরা কী কারণে মারা যায়, তা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুমান করা যায়, হ্রদটির পানির পৃষ্ঠ আলোর নিখুঁত প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে, ফলে প্রাণীরা বিভ্রান্ত হয়ে হ্রদে নেমে পড়ে। তবে এই হ্রদ প্রাণীদের জন্য মৃত্যুপুরী হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

ভাইরাল ছবিটির নেপথ্যের গল্প কী
ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টটিতে ব্যবহৃত মৃত ফ্ল্যামিঙ্গোর ছবিটি নিক ব্র্যান্ডটের তোলা। হ্রদে ঘুরতে গিয়ে ছবিটি তোলেন তিনি। আরও বেশ কিছু ছবি তুলেছিলেন তিনি। ছবিগুলো তোলা হয় ২০১০ এবং ২০১২ সালে। ছবিগুলো সম্পর্কে ব্র্যান্ডট বলেন, তিনি হ্রদটির তীরে ফ্ল্যামিঙ্গোসহ আরও বেশকিছু প্রাণীর দেহাবশেষ খুঁজে পান। প্রাণীগুলোর গায়ে খড়িমাটির মতো সোডিয়াম কার্বনেটের আস্তরণ ছিল। কুড়িয়ে পাওয়ার পর তিনি ছবি তোলার উদ্দেশ্যে অঙ্গ–প্রত্যঙ্গগুলো এমনভাবে সংযোজন করতেন যেন দেখে জীবন্ত মনে হয়। ছবিগুলোতে বিজ্ঞানের চেয়ে শিল্পকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ব্র্যান্ডট।

ন্যাট্রন হ্রদের ভাইরাল ছবিগুলো তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রগ্রাহক নিক ব্র্যান্ডট। ছবি: লাইভ সায়েন্সব্র্যান্ডট বলেন, হ্রদের পানিতে সোডা এবং লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। এই সোডা এবং লবণ প্রাণীগুলোর গায়ে অদ্রবণীয় যৌগের আস্তরণ তৈরি করে চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করে রাখে। তিনি যখন প্রাণীগুলোকে পেয়েছিলেন, এই যৌগের আস্তরণ তৈরির কারণে এগুলোকে পাথরের মতো শক্ত মনে হচ্ছিল। 

ব্র্যান্ডটের এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় যুক্তরাজ্যের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ ডেভিড হার্পারের বক্তব্যে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সাধারণত মরদেহ উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকলে দ্রুত পচে যায়। কিন্তু ন্যাট্রন হ্রদে মৃত প্রাণীর দেহে লবণের আস্তরণ পড়ে, ফলে সেটিকে পচানোর জন্য কোনো অনুজীব আক্রমণ করতে পারে না।

অর্থাৎ, ন্যাট্রন হ্রদটিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ভয়ংকর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বলা হচ্ছে, এখানে কোনো প্রাণী পড়লেই সেটি পাথরে পরিণত হয়—তা সঠিক নয়। মূলত এই হ্রদের পানিতে সোডিয়াম কার্বনেটের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে সেখানে কোনো প্রাণী মারা গেলে গায়ে অদ্রবণীয় ক্ষারীয় যৌগের আস্তরণ পড়ে যাওয়ায় সেটি আর পচে না, একপর্যায়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ফোন-ইন্টারনেট ভাতা পাচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের সব কর্মচারী

এস আলমের জামাতার পেটে ৩৭৪৫ কোটি টাকা

ভাড়া বাড়িতে চলা ১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ

পিপির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ৪৯ জন সহকারী পিপির

জোবাইদার নিরাপত্তার নামে প্রতিবেশীদের বিরক্ত না করার নির্দেশ তারেক রহমানের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত