Ajker Patrika

লোটাসের সারস লিন্ডার রাজহাঁস

সাজিদ মোহন
লোটাসের সারস লিন্ডার রাজহাঁস

কয়েক দিন ধরে বুঁদ হয়ে আছি জি লি জিয়াংয়ের ‘লোটাস অ্যান্ড ফেদার’ গল্পটির ভেতর। ফেদার নামের একটি সারস ও লোটাস নামের একটি ছোট মেয়ের গল্প। লোটাস তার দাদার সঙ্গে বাস করে প্রাণবন্ত এক হ্রদের ধারে ছায়াঘেরা এক গ্রামে। যেখানে মৃদু বাতাসে হ্রদের জলে দোল খায় পদ্মফুল, মাছেরা লাফ দিয়ে উঠে যায় নৌকায়, আকাশে উড়ে উড়ে গান গায় পাখিরা আর ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে শিয়ালগুলো।

লোভী মৎস্যশিকারি ও পাখিশিকারিরা দিন দিন হ্রদটাকে গিলে খাচ্ছে। একদিন সকালে লোটাস দাদার সঙ্গে লেকের ধারে নলখাগড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখে, তুষারের মতো ধবধবে সাদা একটি অনিন্দ্যসুন্দর সারস শিকারির গুলি খেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। দাদা-নাতনির সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে ওঠে সারস পাখিটি, গড়ে ওঠে অদ্ভুত এক ভালোবাসার সম্পর্ক। 
ভালোবাসার প্রতিদান দিতে ভুল করে না পাখিটি। হঠাৎ এক ভূমিকম্পে হ্রদের পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় গ্রাম। গভীর রাতে সবাইকে ডেকে তোলে পাখিটি তার বাজখাঁই গলার শব্দে। প্রাণে বাঁচে গ্রামবাসী। স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পাখিটির বুদ্ধিমত্তার গল্প। রাতারাতি বিখ্যাত হয় ফেদার। নজরে আসে ধ্বংসপ্রায় হ্রদটিও। টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। হ্রদটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় তারা।

শীতের শেষে পরিযায়ী পাখিদের ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। সঙ্গীদের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যায় ফেদার। পরের বছর আবার আসে ফেদার। কড়া নাড়ে লোটাসের দরজায়। একা নয়, সঙ্গে নিয়ে আসে পরিবার-পরিজন। নির্ভয়ে সাঁতরে বেড়ায় প্রাণবন্ত হ্রদে। চীনের একটি গ্রামের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্পটি পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের হাওর, হ্রদ ও জলাশয়গুলোর ছবি। বেজে ওঠে স্বচ্ছ জলে পরিযায়ী পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।

শীতের শুরুতে আমাদের দেশে আনাগোনা দেখা যায় পরিযায়ী পাখির। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তারা আসে হাওর ও উপকূলীয় এলাকায়। সমতলেও দেখা মেলে বেশ কিছু পাখির। আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি জায়গা বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে। একসময় ধারণা ছিল রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখি এ অঞ্চলে আসে। কিন্তু এখন পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখিগুলো মূলত আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা ও হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের এলাকা থেকেই পাখিগুলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসে, যেখানে তুলনামূলক কম ঠান্ডা পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়।

আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে আমাদের দেশে পাখি আছে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক, বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০টি প্রজাতি থেকে যায়। বাংলাদেশে আসে সাধারণত হাঁস আর সৈকত প্রজাতির পাখি। এসব পাখি জীববৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক। প্রকৃতির শোভাবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে এরা জমির ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে, জৈব সার দিয়ে কৃষকের উপকার করে। বাড়ে অভ্যন্তরীণ পর্যটন। পাখিপ্রেমীদের দেয় নিখাদ আনন্দ।

বহু বছর ধরে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি এলেও শৌখিন ও পেশাদার শিকারিদের চোরাগোপ্তা হামলা, জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতা, প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে এসব পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

বার্ড ক্লাব ও আইইউসিএন থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের শুমারি করা হয়। ২০০০ সাল থেকে হওয়া জলচর পাখিশুমারির তথ্য অনুযায়ী দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে শুমারির সময় পাখি ছিল পাঁচ লাখের বেশি। ২০১৯ সালের শুমারিতে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ৫টি এলাকায় পরিযায়ী পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৫টি। পাখির বিচরণ করা এলাকায় মানুষের বসতি ও তৎপরতা বেড়ে যাওয়া এবং নানা ধরনের দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে।

মার্চের শেষ দিকে যখন এ অঞ্চলে গরম পড়তে শুরু করে ও শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলা শুরু হয়, তখন আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাখিগুলো নিজ এলাকায় ফেরত চলে যায়। সবাই কি ফিরে যেতে পারে ফেদারের মতো?

না ফিরতে পারা পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে বিখ্যাত একটি গল্প আছে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর—‘লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস’। একবার এক শিকারি একটি রাজহাঁস শিকারের পর দেখলেন, রক্তাক্ত হাঁসটির পায়ে একটি রুপার রিং পরানো। রিংয়ের গায়ে ইংরেজিতে খোদাই করা—

 ‘এটা আমার পোষা পাখি। এ পাখি শীত ছাড়া বাঁচে না, অথচ আমার দেশে এখন শীত নেই; তাই ছেড়ে দিতে হলো। আবার শীত এলে ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে, দয়া করে পাখিটাকে 
কেউ মেরো না।

-লিন্ডা জনসন, অস্ট্রেলিয়া’

লেখক: শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত