Ajker Patrika

আমাদের প্রেরণাস্থল সন্জীদা খাতুন

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আমাদের প্রেরণাস্থল সন্জীদা খাতুন

কেমন আছেন তিনি? বেশ কিছুদিন খোঁজ নেওয়া হয় না। খোঁজ নিই না ইচ্ছা করেই। মনে হয়, কথা বলতে গিয়ে তাঁর কষ্ট বেড়ে যাবে না তো?

কয়েক মাস আগে বেশ কদিন তাঁর কাছে গেছি। ছায়ানটে নয়, তখন বাড়িতেই ক্লাস নিতেন। পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থী আসত। দিন ঠিক করা ছিল। একেক ব্যাচ একেক দিনে। ছায়ানটের উপকমিটির বৈঠকে কী এক প্রসঙ্গে একদিন মফিদুল হক বললেন, গানের প্রশিক্ষণের ভিডিও করলে ভালো হয়। কথাটা লুফে নিলাম আমি। বললাম, আমিই ভিডিও করতে চাই।

এরপর দিন তিনেক ভিডিও করা হলো। সেটা হয়তো চলত আরও কিছুদিন। কিন্তু ঘটল এক দুর্ঘটনা। সে কথাই বলি।

সুফিয়া কামালকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র হবে, সে তথ্যচিত্রের পরিচালক দেখা করতে চান তাঁর সঙ্গে। সুলতানা কামাল তাঁর সঙ্গে কথা বলে সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন। সন্জীদা খাতুন আমাকে ফোন করে বললেন, ‘তুইও থাকবি সঙ্গে।’

কিন্তু নির্ধারিত দিনে সেই পরিচালকের ফোন, ‘আমাদের তিনি ঢুকতে দিচ্ছেন না। আপনি না এলে ঢোকা বারণ।’

কী হতে পারে? কেন এমন হলো? সেদিন তো গানের ক্লাসও আছে। চিন্তিত মনে তাঁর বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে পৌঁছানোর পর বসার ঘরে ক্যামেরা, আলো ঠিকঠাক করা হচ্ছে যখন, তখন নিজের ঘর থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন তিনি। বসে আছেন বিছানায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শরীর ভালো নয়। বললেন, ‘উঠতে পারছি না। গানের লোকজনকে আসতে মানা করে দিয়েছি, এরা আসবে, তা তো মনে ছিল না। আমি দাঁড়াতেই পারছি না। ওদের বলে দে, একটু সুস্থ হলে কথা বলব। তোকে জানিয়ে দেব।’

ক্যামেরা, আলো আবার ঢুকে গেল যে যার জায়গায়। বেরিয়ে এলাম আমরা।

এরপর আর ফোন করা হয়নি। তিনি তো বলেছেন, নিজেই ফোন করবেন। মাঝে মাঝে অবশ্য মনে হয়েছে, তিনি কি আগের মতো আবার ক্লাস নিচ্ছেন গানের? নাকি এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেননি। গানের ক্লাস নেওয়া শুরু করলে তো ডাকতেন আমাকে! যারা তাঁর বাড়ি গিয়ে গান শেখে, তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কি ক্লাস নিচ্ছেন? উত্তর এল, ‘না।’

তাতে শঙ্কাও হয়, ভালোও লাগে। শঙ্কা—শরীরটা কি এখনো ভালো হলো না তাঁর? ভালো লাগা—আমাকে এড়িয়ে গান শেখানো শুরু করেননি তাহলে। অপেক্ষা করি একটা ফোনের জন্য। হয়তো বলবেন, ‘অ্যাই শোন, কাল আসতে পারবি? গানের ওরা আসবে।’

এ কথা শুনলেই, আমি নিশ্চিত জানি, আমার মনে উড়ে বেড়াবে দখিনা হাওয়ায়! ক্যামেরা আর মোবাইলে গানের ক্লাসটি রেকর্ড করার সময় মাঝে মাঝে তাঁর দিকে তাকাব। দেখব, এই বয়সেও কীভাবে তিনি বাজিয়ে চলেছেন হারমোনিয়াম আর প্রশিক্ষণার্থীদের কণ্ঠে তুলে দিচ্ছেন গান!

৩ এপ্রিলও তাঁকে ফোন করার সাহস হয় না আমার। ফোন করি ছেলে পার্থ তানভীর নভেদকে। ‘কেমন আছেন আপা?’ জিজ্ঞেস করি।

‘আগের চেয়ে ভালো।’ পার্থ জানান।

‘আপাকে ফোন করতে ভয় হয়। কেমন যেন ক্লান্ত থাকেন তিনি।’

‘হ্যাঁ, বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করে না তাঁর।’

‘আমি ফোন করব না তাঁকে। শুধু বলেন, ভালো আছেন তো তিনি?’

‘হ্যাঁ, আগের চেয়ে ভালো।’

‘৯১ পেরিয়ে গেলেন, তাই না?’ নিজের মনেই বলি। তখনই মনে হয়, একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আর ভালো লাগে না রে!’

চোখের জ্যোতি ম্লান হচ্ছে, পা হয়ে যাচ্ছে নড়বড়ে—এসব একেবারে সহ্য হয় না তাঁর। তারপরও তিনি কারও সাহায্য নিতে চান না। চাকাওয়ালা একটি ইস্পাতের যন্ত্রের সাহায্যে হাঁটতে থাকেন। কেউ যদি বলে, ‘একটু ধরব?’

কঠোর কণ্ঠে বলেন, ‘না।’

তখন তাঁর সামনে যারা থাকে, তাঁরা বুঝতে পারে, সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন নিজের মতো করে। জীবনের এই প্রান্তে এসেও সেই ঋজু কণ্ঠস্বরটাই শোনা যায়।

শুভ জন্মদিন, সন্জীদা খাতুন। আপনি জানেন না, কত মানুষ আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছে। আপনি জানেন না, কত মানুষের প্রেরণাস্থল আপনি। ভাষা-সংস্কৃতি ও দেশকে আপনি যা দিয়েছেন, সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আরও অনেক দিন আপনাকে আমরা চাই এই দেশের জল-হাওয়ার মধ্যে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি বাসভবনে একাই থাকতেন শরীয়তপুরের ডিসি, পরিবার থাকত ঢাকায়

‘তোরা তো পুলিশ মারছিস, ফাঁড়ি জ্বালাইছিস’ বলেই জুলাই যোদ্ধাকে মারধর

কারাগারে ১০৫ মন্ত্রী-এমপি

বুশেহরে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে ‘ফুকুশিমা’ ঘটতে পারে, বিশ্লেষকদের হুঁশিয়ারি

ইউআইইউ শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ও পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত