Ajker Patrika

প্রাণজগতে মানবিকতার ব্যাপ্তি জরুরি

আসিফ
প্রাণজগতে মানবিকতার ব্যাপ্তি জরুরি

এ দেশের সমুদ্রসৈকতে তিমিদের ভেসে আসা খুব দুর্লভ ঘটনা নয়। যদিও তিমিদের ব্যাপারে সমুদ্রপ্রাণ বিশেষজ্ঞ বা মেরিন লাইফ এক্সপার্টদের অংশগ্রহণ খুব কম দেখা যায় এবং সে ধরনের অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সরকারি বিশেষজ্ঞরা কিছু দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। ১৯ এপ্রিল কলাতলী সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা মৃত তিমির ঘটনা আবার বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এর আগে ২০২১ সালে এই সৈকতে একই জাতের দুটো তিমি মৃত অবস্থায় ভেসে এসেছিল। ৩০ বছরের গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে দেখা যায়, এ ধরনের বা তার কাছাকাছি আকৃতির তিমি এ অঞ্চলে প্রায়ই ভেসে আসছে। কেন এমন ঘটছে? বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে কি আসলে কোনো অন্তরায় দেখা দিচ্ছে? এ ধরনের কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চোখে পড়ে না।

তবে এবার ভেসে আসা তিমিকে আগের মতো অতিকায় মৎস্য বলা হয়নি। আসলে এ তিমিটি হলো ব্রাইডস প্রজাতির। এর বৈজ্ঞানিক নাম বেলিনিওপেট্রা ইডিনি। এই তিমির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪২ ফুট, পেটের কাছে ব্যাস ২৪ ফুট। এ জাতের তিমির ওজন হয় ১২ থেকে ২৫ টন। তবে এর লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। বিগত নবম ও দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়েও স্তন্যপায়ী তিমিকে ‘তিমি মাছ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সেগুলো থেকে আশা করি আমাদের উত্তরণ ঘটেছে।

এ ধরনের তিমি সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চোখে পড়ে। বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উত্তর প্রান্ত এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, কক্সবাজারের পশ্চিমে এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে ব্রাইডস জাতের তিমি দেখতে পাওয়া যায়। তবে তিমির বিচরণে গভীর ও উষ্ণ জলের প্রয়োজন হওয়ায় ভারত, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান মনে করা হয়।

সামুদ্রিক প্রাণ বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে ধারণা করা যায়, গভীর সাগরে বড় মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে প্রবালের আঘাতে মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় এবং মৃত্যু ঘটে; অথবা শিকারিরাও তিমিটিকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে, কিংবা মারাত্মক শব্দদূষণের কারণে পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে উপকূলে অগভীর জলে এসে আটকা পড়ে মারা যেতে পারে। আবার এটাও হতে পারে, এই স্তন্যপায়ী সংবেদনশীল প্রাণীটি কখনো সঙ্গীর মৃত্যু হলেও সাগরের অগভীর জলে এদের আত্মাহুতি দিতেও দেখা যায়।

এই তিমিগুলো ব্যালিনপেটরা গোত্রের; তাদের আছে দীর্ঘ শৈশবকাল, যে সময়ের মধ্যে পূর্ণবয়স্করা তরুণদের শিক্ষা দেয়। খেলাধুলা তাদের সাধারণ অবসর-বিনোদন। এগুলো স্তন্যপায়ীদের স্বাভাবিক ধর্ম এবং বুদ্ধিমান প্রাণীদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাগর হলো ঝাপসা, প্রায় অন্ধকার একটা জায়গা। স্থলভাগে প্রাণীদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি যত ভালোভাবে কাজ করে, মহাসাগরের গভীরে তত ভালোভাবে কাজ করে না। তিমিদের পূর্বপুরুষেরা যারা ওই ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর ভরসা করে তাদের বাচ্চা, সঙ্গী অথবা শত্রুর অবস্থান খুঁজে বের করত, তারা খুব বেশি বংশধর রেখে যেত না। সুতরাং বিবর্তনের মাধ্যমে অন্য একটি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিল। তিমিদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এটাই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা: শব্দ ইন্দ্রিয়ের।

জীববিজ্ঞানী রজার পাইন গভীর সাগরের শব্দপথ হিসাব করে দেখেছেন, দুটো তিমি পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থান করেও পরস্পরের সঙ্গে ২০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করে কথা বলতে পারে। তিমিদের ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় ধরে তারা হয়তো প্রতিষ্ঠা করে থাকতে পারে এ ধরনের বিশ্বজনীন যোগাযোগের শব্দ জাল। পরস্পর থেকে তারা ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে থাকলেও অতল গভীরতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসার গানে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বর তারা পাঠাতে পারে।

১৯৭০ সালে রজার পাইন ও তাঁর স্ত্রী কেটি পাইনের বারমুডা থেকে তিমির কিছু গান রেকর্ড প্রচেষ্টায় যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় শব্দ বা সাউন্ড শিটের মাধ্যমে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাদের সদস্যদের সঙ্গে এই উল্লেখযোগ্য গানগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রায় দেড় কোটি কপি শব্দ শিটের অর্ডার দিয়েছিল তাদের বৌদ্ধিক অবস্থানের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।

১৯৭৭ সালে ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ মহাকাশযান ১৯৯০ সালের দিকে সৌরজগৎ ছাড়িয়ে নক্ষত্রের পথে চলে যায়। সেখানে মানুষের ৫৫টি ভাষাসহ হাম্পব্যাক তিমির সম্ভাষণসূচক শব্দযুক্ত গোল্ডেন রেকর্ড রয়েছে। পৃথিবীর শব্দ শিরোনামে ঘণ্টার রেকর্ডের একটি অংশে আছে জাতিসংঘের ৬০টি সদস্যদেশের সম্ভাষণ-সূচক শব্দ ৫৫টি ভাষায়। বার্তাগুলোর মধ্যে দীর্ঘতর ছিল হাম্পব্যাক তিমির সম্ভাষণ-সূচক শব্দ, যা রেকর্ড করেছিলেন বারমুডা থেকে ১৯৭০ সালে রজার পাইন ও তাঁর স্ত্রী কেটি পাইন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বহির্জাগতিক সভ্যতা মহাজগতে এই মহাকাশযান খুঁজে পায়, তাহলে তারা গোল্ডেন রেকর্ডটি থেকে বুঝতে পারবে মানুষ ছাড়াও বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীতে রয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বড় এবং সহাবস্থান করছে। কার্ল সাগানের 
ভাষায়, উপযোগী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে তারা প্রাযুক্তিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি; কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের হয়তো রয়েছে গভীর উপলব্ধি, অনুভূতি। 

অথচ এই তিমিকে আমরা হত্যা করে লিপস্টিকের মতো অনেক ধরনের প্রসাধন দ্রব্য বানাই। আজ পৃথিবীতে সহনশীলতা নমনীয়তার প্রচণ্ড অভাব, রয়েছে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার অজ্ঞতা এবং লোভ। তিমিদের সঙ্গে সহনশীল অভিজ্ঞতাই আমাদের শেখাতে পারে শুধু দুই জাতির মানুষ নয়, প্রজাতি নয়, দুটি সম্পূর্ণ আলাদা গোত্রের বুদ্ধিমান প্রাণীও একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে। তাই শুধু মানুষের সঙ্গে নয়, অস্তিত্ব রক্ষায় তিমি ও অন্যান্য প্রাণের সঙ্গে মানবিক আচরণ জরুরি।

আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপল ইসরায়েল, তেহরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি থেকে বিদায় নিচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত