Ajker Patrika

ফুলের অসুখ

সাজিদ মোহন
ফুলের অসুখ

পয়লা কার্তিক। হেমন্তের শুরু। দিনভর বন-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছি প্রকাণ্ড এক কদমগাছের ছায়ায়। আচমকা ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, গাছভর্তি কদম ফুল। একি কাণ্ড! কদম ফুল বর্ষার দূত। বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে আধুনিক কালের হুমায়ূন আহমেদের কাব্যগীতেও বর্ষা ও কদমের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন।

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
চলে এসো এক বরষায়
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী
কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি…’

বর্ষা শেষ হয়েছে সেই কখন। শরৎকালও শেষ। হেমন্তের প্রথম দিনে গাছভর্তি বর্ষার দূত কদম! এখানেই শেষ নয় বিস্ময়ের। ঘুরতে ঘুরতে এবার দেখা মিলল হিজলের! জীবনানন্দ দাশ হিজলের সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন একাধিক কবিতা।

‘ওখানে হিজলগাছ ছিল এক পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে
তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা
চলে গেল কবে যে নীরবে।’ 

বইপত্রে পড়েছি হিজল গ্রীষ্মের ফুল, ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। বাস্তবে দেখি, ফুটে আছে হেমন্তকালে। এর কিছুদিন পর ৬ কার্তিক (২২ অক্টোবর) সাংবাদিক জ ই মামুন ধানমন্ডি লেক থেকে তোলা কয়েকটি হিজল ফুলের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লিখলেন,

‘হিজলের অকাল সকাল
আগে দেখতাম হিজল গ্রীষ্মে ফোটে, 
এখন দেখছি হেমন্তেও ফুটছে। এর কারণ কি জলবায়ু পরিবর্তন...’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে স্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। জুলাই মাসে ৫৭ শতাংশ, আগস্টে ৩৬ শতাংশের কম ও সেপ্টেম্বরে ৩ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে গরম। বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে, শীতকাল সংকুচিত হচ্ছে।

ষড়্ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। দুই মাসে একটি ঋতু। বইপত্রে এমনটা লেখা থাকলেও প্রকৃতিতে শরৎ ও হেমন্ত নামে আলাদা দুটি ঋতুকে আলাদা করে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। শরৎ ঋতু বর্ষার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কোনো কোনো বছর হেমন্তের আচরণ শীতের মতো হয়ে পড়ছে। আচরণ বদলে গেছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্তেরও। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হিজল-কদমের মতো অনেক ফুলই বদলে ফেলেছে ফোটার মৌসুম। শীতের ব্যাপ্তিকাল কমে যাওয়া, বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হওয়া, বৃষ্টিহীনতার কারণে গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ফুল ফোটার সময়ের রকমফের ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফল ভোগ করছি আমরা। প্রতিবছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭৪ ডিগ্রি বাড়ছে। বাংলাদেশে বাড়ছে শূন্য দশমিক ৭০ ডিগ্রি হারে। তাপমাত্রা আরও ২-৩ ডিগ্রি বাড়লে আরও বেশি মেঘ উড়বে আকাশে, কিন্তু বৃষ্টি হবে না।

বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, নগরায়ণ ও গ্রিনহাউসের প্রভাবের কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। বদলে যাবে আমাদের সাহিত্য, সাহিত্যে প্রকৃতির অনুষঙ্গ। বদলে যাবে হাজার বছর ধরে প্রকৃতি ও সাহিত্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবন ও প্রকৃতিবোধ।

রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ২৮৩টি। ঋতুবৈচিত্র্যে তিনি গানগুলোকে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত—এ ষড়্‌ঋতুক্রম অনুযায়ীই ভাগ করে গীতবিতানে গ্রন্থিত করেছেন। গীতবিতান অনুযায়ী গ্রীষ্মের গান ২৬, বর্ষার গান ১১৪, শরতের গান ৩০, হেমন্তের গান ৫, শীতের গান ১০, বসন্তের গান ৯৮। গান ছাড়াও রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশাল অংশজুড়ে আছে ঋতুভিত্তিক ফুল-প্রকৃতির অনুষঙ্গ। বাংলার জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা প্রতিটি লেখকেরই লেখায় অনিবার্যভাবে এসে যায় ফুল-প্রকৃতির প্রসঙ্গ। এমনভাবে ফুলের সঙ্গে ঋতুর মেলবন্ধন ঘটান তাঁরা, নির্দিষ্ট সেই ফুলটিই হয়ে ওঠে ওই ঋতুটির প্রতিশব্দ। আবার কিছু কিছু ফুলের সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক এতই গভীর, চোখ বন্ধ করে শুধু ফুলের গন্ধ পেলেই বলে দেওয়া যায় কোন ঋতু।

সম্ভবত সেটা আর সম্ভব হবে না ভবিষ্যতে। পাল্টে যাচ্ছে ফুল ফোটার সময়। একটা সময় জীবনানন্দ দাশের হেমন্তকে খুঁজে পাওয়া যাবে না শিউলি ফুলের গন্ধে। রবীন্দ্রনাথের ষড়্ঋতুর গানের সুধা পান করার আগেই খুলে বসতে হবে জলবায়ুর ইতিহাস। মেঘদূতের বিরহী যক্ষের মতো কোনো প্রেমিক ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ তুলে দিতে প্রেমিকার খোঁপায়, বর্ষা খুঁজে পেলে খুঁজে পাবে না কদম, কদম খুঁজে পেলে খুঁজে পাবে না ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’। 

লেখক: শিশু সাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত