Ajker Patrika

সংরক্ষিত সৈকতের দেশে স্বাগত

ফজলুল কবির
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬: ১৮
সংরক্ষিত সৈকতের দেশে স্বাগত

এই মুহূর্তে দেশে বেশ কিছু বিষয় আলোচিত ঘটনা হিসেবে রাজ কায়েম করার লড়াই করছে। এ ক্ষেত্রে এক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনই যথেষ্ট ছিল। একেক এলাকার নির্বাচনী সহিংসতা যদি নিজের দিকে অন্যদের নজর কাড়তে চায়, তো অন্য এলাকায় হত্যা ও জখমের আধিক্য দিয়ে সে নজর ফেরাতে মরিয়া। আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ জন তো কাল হবিগঞ্জে ৫০ জন আহত হয়ে প্রতিযোগিতার টানটান উত্তেজনা অক্ষুণ্ন রাখছে। এই প্রতিযোগিতার উত্তেজনা এতটাই প্রবল যে, কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়ে নারী পর্যটকের ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি তো অনুপ্রেরণার অভাবে নেতিয়ে পড়া ক্রীড়াবিদের মতো নুয়ে পড়েছে।

কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়ে এক নারী পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তা-ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। ঘটনা সম্পর্কে নানা ধরনের বয়ান এর পর উঠে এসেছে নানা পক্ষ থেকে। যদিও এসব বয়ানের সবকটিই এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে। ভুক্তভোগী বা ভুক্তভোগীর স্বামী কী বলেছেন, তাঁরা কী করতে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন, ঘটনার শুরু ও বিস্তার কীভাবে—এই সব বিষয়ের কোনোটিই ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সরাসরি জানা সম্ভব হয়নি। যতটা যা জানা গেছে, তা এসেছে হয় পুলিশ, নয়তো র‍্যাবের পক্ষ থেকে। আর এই বক্তব্য কোনোভাবেই এক নয়। কখনো কখনো সাংঘর্ষিক বক্তব্য এসেছে এ দুই পক্ষ থেকে।

ঘটনার একপর্যায়ে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এর কথা উঠে এসেছিল। অভিযোগ ছিল—৯৯৯-এ ফোন করেও ভুক্তভোগী নারী কোনো সেবা পাননি। এ বিষয়টিই পুলিশকে ক্ষুব্ধ করেছে? এর কারণেই কি বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভুক্তভোগীর চরিত্রহনন করা যায়, তেমন কিছু তথ্য পুলিশের বরাত দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে? নাকি এলিট ফোর্স র‍্যাবের সঙ্গে পুলিশের কথিত প্রতিযোগিতার ফেরে পড়েছিলেন ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবার? প্রসঙ্গত, ৯৯৯ থেকে সেবা পেতে ব্যর্থ হয়ে র‍্যাবের শরণ নিয়েছিলেন ওই নারী। আর র‍্যাবই তাঁকে উদ্ধার করেছিল।

পুলিশ ভুক্তভোগী নারী ও তাঁর পরিবারকে আটক করে রেখেছিল। বলা হচ্ছিল—হেফাজত। পুলিশের প্রথম ভাষ্য ছিল—তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। কী আশ্চর্য, অভিযোগকারী ব্যক্তিই জোরদার জিজ্ঞাসাবাদের মুখে! তা বেশ অপরাধীর কী হলো? এই প্রশ্নগুলো যখন উঠতে শুরু করেছে, তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বয়ান বদলে বলা হলো—অভিযোগকারী ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থেই থানা হেফাজতে তাঁদের রাখা হয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে জোর আলোচনা শুরু হলে, পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। অবশ্য তার আগেই ভুক্তভোগীর স্বামী বলে দিয়েছেন মিডিয়ার সামনে যে, তাঁকে এই পরিবেশে যা বলতে বলা হচ্ছে, তা-ই তিনি বলছেন। অর্থাৎ, বলতে বাধ্য হচ্ছেন। এ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আঁচ করতে কষ্ট হয় না। বিশেষত অপরাধী ব্যক্তিরা যখন পুলিশের ভাষ্যমতেই, স্থানীয় প্রভাবশালী ও অপরাধ চক্রের অংশ।

ফজলুল-কবিরকক্সবাজারের মতো একটি পর্যটন এলাকায়, যেখানে মাদকের অবাধ চলাচল, শরণার্থীশিবির, নানা মুদ্রা ও পণ্যের নানা খেলা চলে, সেখানে অপরাধী চক্র ও প্রশাসন তো একটু পাশ ঘেঁষে বসবেই। একটা যোগাযোগ থাকতেই পারে। এটা শুধু এই দেশ বলে নয়, অনেক দেশেই মাদক ও পর্যটনের সংগমস্থলে এমন দেখা যায়। তাই যখন প্রথম ধর্ষণের অভিযোগ আমরা শুনি, যখন প্রথম শুনি ৯৯৯ থেকে সেবা না পাওয়ার অভিযোগ, তখন কক্সবাজারের পুলিশ কর্মকর্তার মুখ থেকে এর তদন্তের কথা বলতে না শুনে আমরা শুনি—এটা অসম্ভব। হতেই পারে না। কক্সবাজার বাংলাদেশের, কক্সবাজার বিশ্বের। এখানে কোনো অপরাধ ঘটতে দেব না। কথাগুলো যতটা প্রশাসনিক কর্মকর্তার, তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনৈতিক নেতার মতো নয় কি? এই ভাষ্যই হলো সেই সিঁদুরে মেঘ, যা বলে দিয়েছিল, সামনে জল অনেক ঘোলা হবে।

হয়েছেও। এতটাই যে, অভিযুক্ত গ্রেপ্তারে সময় লাগলেও নিরাপত্তার নামে ভুক্তভোগীকে আটকে রাখতে সময় লাগেনি। এটা এতটাই যে, ভুক্তভোগীর স্বামীর কাছ থেকে এই আর্তনাদটিও শুনতে হয়েছে যে, তাঁরা ঢাকায় ফিরে একটু স্বস্তি চান। তাঁরা নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে নিরাপত্তা চাননি। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারকে ঢাকায় নিজ বাসায় ফিরতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদতে কি তাঁরা নিজের জীবনে ফিরতে পেরেছেন?

তদন্তে যা-ই আসুক, পুলিশ বা র‍্যাব যার ভাষ্যই সামনে আসুক শেষ পর্যন্ত, সত্য হচ্ছে—কক্সবাজারে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে যাওয়া এক নারীকে সৈকত থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁকে দুবার দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর এই সময় ওই নারী ৯৯৯-এ ফোন করেও সেবা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। এই ঘটনার পর থেকে পুলিশ শুধু ওই নারী ‘পর্যটক’ নন—তা প্রমাণেই সচেষ্ট ছিল। যেন ওই নারী ‘পর্যটক নন’ প্রমাণিত হলেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যটকবান্ধব ও নিরাপদ বলে বিবেচিত হবে।

এটা অনেকটা সেই কৌতুকের মতো—‘এখানে বুনো হাতি সম্পূর্ণ নিরাপদ’ লেখা ব্যানারের নিচে যতই মরা হাতি পড়ে থাক, বন রক্ষক শেষ পর্যন্ত বলতে থাকে—এটা হাতিই নয়। এ তো ভালুক কেবল। আমাদের তো বুনো হাতির নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল, ভালুকের নয়। এখানেও তা-ই হয়েছে। ওই নারী যেহেতু ‘পর্যটক নন’, সেহেতু ট্যুরিস্ট পুলিশের কাছ থেকে নিরাপত্তা কী করে পেতে পারেন? বা পর্যটন এলাকার পুলিশই বা তাঁকে কী করে নিরাপত্তা দেবে? এমন এক অদ্ভুত অ্যানালজির ফেরে পড়ে কয়দিন গোটা জাতি বেশ বোকা ভান ধরে থাকল। আর গোটা রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা পুংপুঙ্গবেরা দারুণ একটা ‘ডার্ক’ গল্পের সাক্ষী হতে যেন উৎকর্ণ হলো। সেখানে ওই নারীর ধর্ষিত হওয়া, তাঁদের বেড়াতে যাওয়া এবং আহত হওয়ার গল্পগুলো আর কোনো থই পেল না। যেন গল্পের এই মন খারাপ করা অংশটি টপকে ‘ডার্ক’ অংশে যেতে পারলেই সবাই বেঁচে যায়।

আর এই ফাঁকে সৈকতে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে প্রশাসন। তারা পুং-বাংলাদেশকে এক অর্থে স্বীকার করে নিয়েই যেন জানিয়ে দিল—সৈকতে নারীদের জন্য আলাদা এলাকা থাকবে। হায় চোখের সামনে একদল অকম্মার ফেরে পড়ে আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ সৈকতটিও ‘লোকাল বাস’ হয়ে গেল, নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণই যেখানে দস্তুর। কে না জানে, সংরক্ষিত অঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় বা নিদেনপক্ষে বিপন্ন প্রাণীদের জন্য ঘোষণা করা হয়। এ দেশে সমুদ্রের সামনে নারীকেও তবে তা-ই করা হলো! হায় এত বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়েও আমরা এই ক্ষুদ্রতার পাঁকেই শুধু ডুবে মরব। কক্সবাজার সৈকতে কেন এত চোরাবালি, তার উত্তর বোধ হয়অবশেষে জানা হয়ে গেল।

ফজলুল কবির: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অপারেশন সিন্দুর ঘিরে আলোচিত কে এই কর্নেল সোফিয়া কুরেশি

ভাগনের বিয়েতে ১ কেজি সোনা, ৪ বস্তা টাকা, ২১০ বিঘা জমি, পেট্রলপাম্প উপহার দিল মাড়োয়ারি পরিবার

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এমডির অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে কর্মীরা

আস্থায় বাজিমাত ইসলামী ব্যাংক

চট্টগ্রামে র‍্যাব কর্মকর্তার লাশ: মাকে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কলহে আত্মহত্যা বলে দাবি ভাইয়ের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত