Ajker Patrika

গাফ্‌ফার চৌধুরীর স্মৃতি

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ২১ মে ২০২২, ১১: ৫৮
গাফ্‌ফার চৌধুরীর স্মৃতি

ব্যক্তিগত কথা দিয়েই শুরু করি। আমরা ‘গাফ্ফার কাকা’ নামটা শুনেছি অনেক। কিন্তু আমাদের শৈশবেই তিনি দেশ ছেড়েছিলেন। স্ত্রীর অসুখের কারণে লন্ডন গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে, পরের বছর সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। বিলেতে কষ্টকর জীবনের শুরু হয়েছিল তখন।

তুখোড় সাংবাদিক ছিলেন। আমার আব্বা সিরাজুদ্দীন হোসেনের চেয়ে বয়সে ছিলেন বেশ কয়েক বছরের ছোট। কিন্তু শুনেছি, আব্বাও গাফ্ফার কাকার লেখার খুব প্রশংসা করতেন। নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ ছিল তাঁর খুব। তাঁর লেখার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সাংবাদিকতার ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের ভাষার মিশ্রণ। পরিপাটি ভাষা ও মজলিশি আড্ডার ঢঙে ঘটনার বর্ণনা অনেক সময় তাঁর সিরিয়াস রাজনৈতিক লেখাগুলোকেও গল্পের আমেজ দিতে পারত। আরও একটা ব্যাপার উল্লেখ করা ভালো, তিনি চাইলে যেকোনো দিকে নিজের শাণিত যুক্তি দিয়ে লড়াই করতে পারতেন; অর্থাৎ যে বিষয়ে লিখছেন, তার বিপরীত পক্ষের হয়ে যদি লিখতে বলা হতো, আমি নিশ্চিত, তিনি একইভাবে সেদিকেও যুক্তির জাল বিস্তার করতে পারতেন।

একজন গল্পকার, তথা সাহিত্যিক হিসেবেও নাম করতে পারতেন তিনি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত আর বেগমে লেখার জন্য যে তরুণদের ভিড় ছিল, তাঁদেরই একজন ছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। কিন্তু লিখে সংসার চালাতে পারা কঠিন, সেটা যখন বুঝে গেলেন, তখন ঝুঁকলেন সাংবাদিকতার দিকে। তিনিই তো বলেছেন, কোনো গল্প বা ওই ধরনের লেখা লিখলে ১০০ টাকা সম্মানীর জন্য ১০০ বার ঘুরতে হতো প্রকাশকের দ্বারে। কিন্তু সংবাদপত্রে কলাম লিখলে অনায়াসেই মাসে ৪০০ টাকা আয় করা যেত।

ঢাকায় এসেছিলেন শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময়। আমার মেজো ভাই শাহীন ভাই তাঁকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁর কথা শোনার জন্য বাড়িভর্তি মানুষ এসেছিল। নির্ধারিত সময়ের বেশ পরে এসে হাজির হয়েছিলেন তিনি। আম্মার পাশে বসে বৈঠকি আড্ডায় বলেছিলেন অনেক কথা। সেই আলাপের ভিডিও আছে আমাদের কাছে। আব্বার কথা বলেছিলেন, তৎকালীন সাংবাদিকতার কথা বলেছিলেন এবং পরে খাবার টেবিলে অব দ্য রেকর্ড আরও অনেক কথা বলেছিলেন। মনে আছে তা।

একবার একটা বড় ভুল করে ফেললেন তিনি তাঁর কলামে। জনকণ্ঠে প্রকাশিত কলামে সিরাজুদ্দীন হোসেনের একটা কৃতিত্বকে তিনি কে জি মুস্তাফার কৃতিত্ব বলে লিখে বসেন। সাংবাদিকতার জন্য সেই ঘটনা ছিল এক মাইলফলক। প্রকাশ হওয়ার পর স্বভাবতই আমি আমাদের অফিসে আমার ক্ষোভ প্রকাশ করি। প্রতিবাদপত্র দেওয়ার জন্য তৈরি হই। কিন্তু সে সময় সাংবাদিক এবিএম মূসা ছিলেন আমার সামনে। তিনি ঘটনা শুনে নিয়ে তখনই ফোন করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। আমার ক্ষোভের কথাও জানান। পরদিনই গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর ভুলের জন্য সংশোধনী দিয়েছিলেন। এরপর যতবার আমাদের কোনো ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে বা কোনো ভাইকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তখনই ঘটনাটির কথা উল্লেখ করে কীভাবে তিনি ঘটনাটির ক্ষেত্রে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিলেন, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন।

একটি বড় ঐতিহাসিক ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার জন্য করাচি হয়ে লাহোর যাওয়ার সময় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আলফা ইনস্যুরেন্সের অফিসে ডেকে নিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। গাফ্ফার চৌধুরীর সামনেই তিনি সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতে ছয় দফার খসড়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওখানে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। সে রকম কিছু হলে ছেপে দিবি।’

সিরাজুদ্দীন হোসেন কলেজজীবন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু ছিলেন। আজাদে থাকা অবস্থায় কৌশলে বন্ধু মুজিবের সংবাদ ছাপতেন আজাদে। এরপর ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের খবরগুলোর উল্লেখযোগ্য ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন। সে সময় পর্যন্ত ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছয় দফাকে সমর্থন দেননি। তাই সিরাজুদ্দীন হোসেন সেই ছয় দফার খসড়া তুলে দিয়েছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাতে। তিনি তাঁর সান্ধ্য দৈনিক ‘আওয়াজ’-এ সেটা ছেপেছিলেন।

আর একটা কথা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি গান হয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বাঁচিয়ে রাখবে এই জাতির মনে, এ কথা প্রত্যয়ী কণ্ঠেই বলা যায়।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

আইপিএলে চাহালের রেকর্ড হ্যাটট্রিকের রাতে রহস্যময় পোস্ট এই নারীর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত