Ajker Patrika

উড়ন্ত ডলফিন

সাজিদ মোহন
উড়ন্ত ডলফিন

কিছুদিন আগে অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম বেসরকারি একটি হাসপাতালে। লিফটের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় চোখ আটকে গেল কিছু জিনিসপত্রের দিকে। জিনিসপত্রগুলো দেখে বুঝলাম, দীর্ঘদিন পর হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছেন কেউ। রোগী বা রোগীর সঙ্গের কাউকে দেখলাম না। হয়তো জিনিসপত্রগুলো রেখে ফার্মেসিতে গেছেন অথবা গেছেন গাড়ি ঠিক করতে।

লিফট আটতলা থেকে আসতে দেরি হওয়ায় জিনিসপত্রগুলোর দিকে ভালো করে তাকালাম। পেট ফোলা বড় একটি কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর সম্ভবত কাপড়চোপড়, কাঁথা-বালিশ। পাশে একটি পলিথিনের ব্যাগ থেকে মাথা বের করে আছে একটি টেবিল ফ্যান। বেসরকারি হাসপাতালে বিদ্যুৎ চলে গেলেও জেনারেটর দিয়ে তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রোগীর জন্য আলাদা আলাদা কেবিনে সিলিং ফ্যান ঘোরে। তাহলে টেবিল ফ্যান কেন? ফ্যানের সূত্র ধরে কল্পনা করতে লাগলাম রোগীর অবয়ব।

একবার এক আত্মীয় সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক মাস অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন। শুয়ে থাকতে থাকতে তাঁর পিঠে ক্ষত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ঠিক এ রকম একটি ফ্যান কিনতে হয়েছিল। এপাশ-ওপাশ কাত করে তাঁকে বাতাস করতে হতো। ফ্যানটা চোখের সামনে না দেখা রোগীর একটা অবয়ব তৈরি করে দিল।

টেবিল ফ্যানের ব্যাগটায় একগাদা টেস্টের রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন। ব্যাগভর্তি রিপোর্টের বেশির ভাগই হয়তো অপ্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে একশ্রেণির নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত অর্থলোভী চিকিৎসক বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির সঙ্গে গোপন চুক্তিতে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর কমিশন নেন।

কমিশনের লোভেই কতিপয় চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করান এবং প্রতি টেস্টে ৫০ শতাংশ কমিশন পকেটে ভরেন। প্রয়োজনীয় টেস্ট বাবদও তাঁরা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পান। যত পরীক্ষা, তত ডাক্তারের লাভ আর মাথায় হাত রোগীদের; বিশেষ করে গরিব ও নিম্নবিত্ত রোগীরা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব।

ভাগ্যিস কোনো মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের চোখে পড়েনি ব্যাগটা! ব্যাগটা তাঁদের জন্য এক রত্নভান্ডার। চোখে পড়লে প্রেসক্রিপশনগুলো বের করে ফটাফট ছবি তুলে নিতেন। ছবি তোলার কারণ, প্রেসক্রিপশনে নিজেদের কোম্পানির ওষুধের নাম লেখা কি না, তা যাচাই করা। নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন ও দামি গিফট দেওয়া হয় ডাক্তারদের। ‘নুন খাই যার, গুণ গাই তার’ প্রবাদটি ডাক্তাররা ঠিকমতো পালন করছেন কি না, রিপ্রেজেনটেটিভরা পরখ করে দেখেন প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে।

রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশনের পাশের ব্যাগটাতে কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল, মোড়া, টিফিন বক্স ইত্যাদি। ওই ব্যাগের পাশেই দেখলাম চারটি পাঁচ লিটারের খালি পানির বোতল। খালি পানির বোতল বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখে পরিবারটির অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারলাম। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে কিছুই ফেলনা নয়। একটি খালি পানির বোতলও পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। অনেকেই বর্ষাকালে এসব বোতলে বৃষ্টির পানি জমা করে রাখেন। সারা বছর এই পানি ব্যবহার করা হয় ভাত রান্না ও চা বানানোর জন্য। রোগী সুস্থ হয়েছেন কি না, বোঝা না গেলেও বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাটিয়ে পরিবারটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

আটতলার লিফট নিচতলায় নেমেছে। দরজা খুলে গেল। ঢোকার আগে আরেকবার দেখে নিলাম জিনিসপত্রগুলো। সেগুলোর সঙ্গে আছে অদ্ভুত আরেকটি জিনিস। একটি গ্যাসভর্তি ডলফিন আকৃতির বেলুন। বেলুনটি যেন উড়ে যেতে না পারে, তাই রশি দিয়ে টেবিল ফ্যানের সঙ্গে বাঁধা।

যে রোগীর কথা বলছিলাম হয়তো সে কোনো শিশু। অথবা বয়স্ক রোগীর সঙ্গে এসেছে কোনো শিশু। পরিবারের দুর্দশা বোঝার বয়স তার হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, ডাক্তারদের কমিশন-বাণিজ্য, ওষুধ কোম্পানির দৌরাত্ম্য, হাসপাতালের গলাকাটা ভাড়া, রুগ্‌ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা—কিছুই বোঝার বয়স হয়নি তার। পৃথিবীটা এখনো তার কাছে সুন্দর, আনন্দময়। একটা উড়ন্ত ডলফিনের মতো।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শিক্ষার্থীদের ‘কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে’ সপরিবারে পালিয়েছেন বিএসবির বাশার

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: পাকিস্তানে নিহত বেড়ে ২৬, ভারতে ১০

সীমান্তে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত: পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী

কাশ্মীরে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ ফরাসি কোম্পানির তৈরি, হতে পারে রাফাল

পাকিস্তানে হামলায় ‘লোইটারিং মিউনিশনস’ ব্যবহারের দাবি ভারতের, এটি কীভাবে কাজ করে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত