Ajker Patrika

আমরা কইতেও পারি না সইতেও পারি না

সাজ্জাদ মাহমুদ খান ও অর্চি হক, ঢাকা
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২১, ১৪: ২১
আমরা কইতেও পারি না সইতেও পারি না

‘ইভ্যালিতে ধরা ৬ লাখ। আরেকটি ই-কমার্সে আছে ১১ লাখ। ইভ্যালির মালিক জেলে গেছে। ইভ্যালির টাকা ফেরত পাওয়ার এখন কোনো আশা দেখছি না। পণ্য কিংবা টাকা চেয়ে যদি অন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও রাস্তায় নামি, তারাও গ্রেপ্তার হলে সামনে অন্ধকার হয়ে যাবে। জমানো টাকা আর ধারদেনা করে সবই বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন আমরা কইতেও পারি না, আবার সইতেও পারি না।’

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করে টাকা আটকে যাওয়ার নিজের দুশ্চিন্তার কথা গতকাল বৃহস্পতিবার এভাবে আজকের পত্রিকার কাছে প্রকাশ করেন মহিউদ্দিন নামে এক যুবক। মহিউদ্দিনের মতো কয়েক লাখ গ্রাহক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পণ্য কিংবা টাকা কোনোটাই ফেরত পাচ্ছেন না। আবার পণ্য ও টাকা ফেরতের জোরালো দাবিও করতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের শঙ্কা, টাকা ফেরতের দাবি করলে মালিক গ্রেপ্তার হবে। এরপর পণ্য কিংবা টাকা কোনোটাই ফেরত পাবেন না। তবে টাকা কিংবা পণ্য কীভাবে ফেরত পাবেন সেটাও তাঁদের অজানা।

পুলিশ বলছে, এ পর্যন্ত ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৬টি মামলা হয়েছে। ২৪টি টিকেট ডটকম ও এসপিসির বিরুদ্ধে ৪টি করে মামলা হয়েছে।

ইভ্যালি ও ধামাকার বিরুদ্ধে ৩টি, রিং আইডি ও সহজ লাইফের বিরুদ্ধে ২টি। নিরাপদ শপ, সিরাজগঞ্জ শপ, আনন্দের বাজার, দালাল প্লাস, কিউকমের বিরুদ্ধে ১টি করে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রিয়শপ, নিডস ডটকম, বুমবুম, আলাদিনের প্রদীপ, ই-শপ ইন্ডিয়া, বিডিলাইক, র‍্যাপিড ক্যাশ-কুইক অনলাইন, ফস্টার করপোরেশন, সহজ লাইফ অ্যান্ড লাইভলি লাইফ, আদিয়ান মার্ট, নিডস, এসকে ট্রেডার্স, মোটরস, চলন্তিকা, সুপন প্রোডাক্ট, আকাশ নীল, এসডিসি ওয়ার্ল্ড, নিউ নাভানাসহ আরও অন্তত ২০টি ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আরও অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। সিআইডির পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও র‍্যাব এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নজরদারি করছে।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলা হওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারও করছি। আরও কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে না, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। আমরা তাদের ব্যাপার অনুসন্ধান করছি। এ ছাড়া যে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে, এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযান শুরু হওয়ার পর বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক আত্মগোপনে চলে গেছেন। কয়েকজন দেশ থেকেও পালিয়েছে। পুলিশ চেষ্টা করছে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে। তবে আসামি গ্রেপ্তার কিংবা শাস্তি হলেও গ্রাহকদের অর্থের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের কিছু করার নেই। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির বলেছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। এখনো পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা তুলে অন্যান্য খাতে ব্যবহার করেছে। বাকি মামলাগুলো প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎসহ অন্যান্য অভিযোগে হয়েছে। দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

কারাবন্দী মালিকদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন ইভ্যালি ও কিউকম ভুক্তভোগীরা। তাঁদের দাবি, মালিকরা মুক্তি পেলে টাকা পাওয়ার আশা কিছুটা হলেও থাকবে। নইলে ডেসটিনি, ইউনিপেটু, যুবকের গ্রাহকেরা যেমন টাকা ফেরত পায়নি, তাঁদেরও তেমনই অবস্থা হবে বলে আশঙ্কা ই-কমার্স ভুক্তভোগীদের।

গ্রাহকদের অভিযোগ, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্যপদ দেখেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন। সে সময় ই-ক্যাব বলেছিল, তাঁদের সদস্যদের কাছে নিশ্চিন্তে পণ্য অর্ডার করা যাবে। অথচ এখন ই-ক্যাবও ই-কমার্স ভুক্তভোগীদের টাকা উদ্ধারে কার্যকর কিছুই করছে না।

তবে ই-ক্যাবের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম শোভন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারের কিছু বিষয় এখন আদালতে চলে গেছে। সেটা এখন আদালতই দেখবেন। আর পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা উদ্ধারে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি জানান, পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ই-ক্যাব চিঠি দিয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের কত টাকা আটকে আছে সেটা দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেও চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।

মালিকেরা পলাতক, ফেসবুকে আস্ফালন
অফিস, ওয়্যারহাউস সবই বন্ধ। পণ্য ডেলিভারি, টাকা ফেরত কার্যক্রম, চলছে না কিছুই। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের খুঁজছে পুলিশ। অথচ তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে আসছেন, প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকিও দিচ্ছেন। আনন্দের বাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমুদুল হক খন্দকার মিঠু পরপর চার দিন ফেসবুক লাইভে এসে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। গ্রাহকদের নানা আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন, সেটা পরিষ্কার করেননি। মিঠুর বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা, পুলিশ তাঁকে খুঁজছে।

অন্যদিকে দালাল প্লাসের সিইও এস এম রাব্বি বুধবার ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন। দালাল প্লাস থেকে পণ্য অর্ডারেরও অনুরোধ করেন তিনি। অথচ দালাল প্লাসের কার্যক্রম এখন বন্ধই বলা চলে। পণ্য ডেলিভারি বা টাকা ফেরত দেওয়া কিছুই করছে না তারা। কিন্তু ফেসবুকে তাদের প্রচারণা চলছে। লাইভে এলেও রাব্বি কোথায় আছেন, সেটা তিনি জানাননি। তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে মামলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাব্বি পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এ ছাড়া বুমবুম শপিং, ধামাকা, রিং আইডিসহ বিভিন্ন ই-কমার্সের মালিকেরা ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নতুন নতুন সময়সীমা এবং পদ্ধতি জানাচ্ছেন। সেসব সময়সীমা পারও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গ্রাহকদের কেউ টাকা ফেরত পেয়েছেন এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত