Ajker Patrika

টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত রেলের কর্মীরা

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ১২: ০০
টিকিট কালোবাজারিতে  জড়িত রেলের কর্মীরা

চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে প্রকাশ্যে ২০০-৩০০ টাকা বাড়তি নিয়ে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও কর্মচারীরা এসব টিকিট বিক্রি করেন। তাঁদের টিকিট পেতে সহযোগিতা করেন স্টেশনের বুকিং সহকারী, স্টেশনমাস্টার ও ম্যানেজার।

এদিকে কাউন্টারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও টিকিট পাচ্ছেন না যাত্রীরা। ১৮-২৫ মার্চ সাত দিন সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতিদিন ৯টি আন্তনগর ও ৬টি মেইল ট্রেন ছেড়ে যায়। এই স্টেশনে প্রতিদিন ৫ হাজার টিকিট বিক্রি হয়।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টিকিট কালোবাজারিতে যায়। প্রতিটি টিকিট থেকে যদি গড়ে ১০০ টাকাও বেশি নেওয়া হয়, তাহলেও প্রতিদিন ৩ লাখ টাকা কালোবাজারিরা হাতিয়ে নেয়।

কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত তিনজন আরএনবি, দুজন বুকিং সহকারী ও স্টেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্টেশনে কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ করেন রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী দেলোয়ার হোসেন, সহকারী স্টেশন মাস্টার শফিকুল ইসলাম ও বুকিং সহকারী মো. জসিম উদ্দিন। এদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে স্টেশনের ব্যবস্থাপক রতন কুমার চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে জসিম রেলওয়ের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারের ভাই। কালোবাজারির অভিযোগে বিভিন্ন সময় তিনি বদলি হলেও ভাইয়ের প্রভাবে আবারও স্টেশনে ফিরে দুর্নীতি করেন।

সহকারী স্টেশন মাস্টার শফিকুল ইসলাম ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে প্রভাব খাটান। অথচ তিনি বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক স্টেশনে ৩ বছরের বেশি চাকরি করার সুযোগ না থাকলেও তিনি ১৪ বছর ধরে রয়েছেন।

প্রধান বুকিং সহকারী দেলোয়ার হোসেন ২০০৫ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর থেকে ঘুরেফিরে চট্টগ্রাম স্টেশনেই চাকরি করছেন। টানা ছয় বছর রয়েছেন এখানে।

এই তিনজন ছাড়া কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে সিএনএস অপারেটর মফিজুর রহমান ও কাওসারের বিরুদ্ধে। ‘সহজ’ দায়িত্ব নেওয়ার পরও তাঁরাই দায়িত্বে আছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম স্টেশনে ৩০ জন বুকিং সহকারী আছেন। এঁদের প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে প্রধান বুকিং সহকারী দেলোয়ারকে দিতে হয়। এ ছাড়া টাকা পাঠাতে হয় বাণিজ্যিক দপ্তরেও। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও রেলওয়ের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কারণে ব্যবস্থা নিতে পারেন না পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা।

যেভাবে কালোবাজারির হাতে টিকিট: সহজ লিমিটেড দায়িত্ব নেওয়ার পর ২১-২৫ মার্চ অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধ ছিল। এ সময় সব টিকিট কাউন্টারে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের আসন সংখ্যা ৯০০ আর সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে ৭৫০টি।

২৪ মার্চ সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম স্টেশনে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সুবর্ণ ও সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের লাইনে ১০০ যাত্রী টিকিট পাওয়ার পরপরই বলা হয় টিকিট শেষ।

আগ্রাবাদ একটি আইটি কোম্পানির চাকরিজীবী হাসানুল বান্না আরমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসে লাইনে দাঁড়াই। সামনে সব মিলিয়ে ১০০ জন ছিল। কিন্তু সুবর্ণ ট্রেনের টিকিট চেয়ে পাইনি। ধরলাম, প্রত্যেকে চারটি করে টিকিট কেটেছে, তাহলেও তো ৫০০ টিকিট থাকার কথা।’

বাণিজ্যিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, টিকিট কেটে রাখার পর হঠাৎ বুকিং সহকারী ও টিকিট অপারেটররা ডিসপ্লে কম্পিউটারে টিকিট নেই শব্দটি জুড়ে দেন। তারপর কেটে রাখা টিকিটগুলো কালোবাজারিদের হাতে বেশি দামে বিক্রি করে দেন। কালোবাজারিরা আরও বেশি দামে যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করেন। রিয়াজ উদ্দিন বাজারেও এসব টিকিট যায়।

২৫ মার্চ রাত ১০টায় প্রকাশ্যে টিকিট বিক্রি করছিলেন আরএনবির সোহেল ও শামীম। তাঁদের কাছ থেকে এই প্রতিবেদক যাত্রী সেজে টিকিট আছে কি না জানতে চাইলে ৩৫০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকা দিলে দেওয়া যাবে বলে জানান।

অভিযোগ আছে, সিপাহি মশিউর রহমান, কুদরত আলী, মাহফিজুর রহমান, নায়েক গাজী সাইফুল ইসলামও টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত।

অনলাইনের টিকিট কেটে রাখা একটু কঠিন হলেও থেমে নেই তাঁরা। টিকিট ছাড়ার প্রথম দিনেই অগ্রিম কেটে রেখে কালোবাজারিরা বেশি দামে বিক্রি করেন।

অভিযান নেই: কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরেই অভিযান পরিচালনা করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আরএনবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা চাইলে কাউন্টারে অভিযান চালাতে পারি। কারা কারা টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত, তা-ও আমরা জানি। কিন্তু অভিযান চালানোর জন্য আরএনবির প্রধান অনুমতি দেন না। নিজ উদ্যোগী হয়ে অভিযান চালালে বহিষ্কার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান বুকিং সহকারী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ দিচ্ছেন, তারাই কালোবাজারিতে জড়িত। আমি এসবের মধ্যে নেই।’ অন্যরা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ইতি ধর বলেন, ‘প্রমাণ না পাওয়ায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেব।’

রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে তেমন কাজ করতে পারিনি। এখন যেহেতু সবকিছু স্বাভাবিক, তাই এসব বিষয়ে কাজ করব। আশা করি, টিকিট কালোবাজারি অচিরেই বন্ধ হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত