Ajker Patrika

জনগণ সচেতন, দায়িত্বশীলদের খবর কী

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১০: ৩০
জনগণ সচেতন, দায়িত্বশীলদের খবর কী

প্রায় প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজারের ওপরে। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ১০। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনটাই বলছে প্রচারমাধ্যম। এর সত্যতা পাওয়া যায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে। লাইন ধরে তীর্থের কাকের মতো ভর্তি হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে ডেঙ্গু রোগী ও তার স্বজনেরা। চিকিৎসাসেবা পাওয়ার এই ব্যাকুলতার রাজনৈতিক কোনো ফায়দা নেই, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রবল তৃষ্ণা আছে; জীবনব্যাপী মানুষের যা থাকে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চপদস্থ এক ব্যক্তি বেদনার সুরে বলছিলেন, তাঁর দুটি সন্তানই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। শরীরে নানাবিধ জটিলতা দেখা দিয়েছে। কদিন ধরে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও তিনি তার সন্তান দুটিকে ভর্তি করতে পারছেন না। সিট পাচ্ছেন না। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর বাসায় ব্যবস্থা নিলেও স্কুলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি তো তাদের আয়ত্তে নেই। এমনকি শিক্ষার্থীরা যখন বাইরে বেরোচ্ছে, তখন তো আর তাদের এডিস মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ অভিভাবকদের থাকছে না। কী করে সন্তানদের আমরা সুরক্ষিত রাখব?

এডিস মশা নিধনে ও এডিস মশা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতি রয়েছে এবং জনসচেতনতার ওপর এই বিজ্ঞাপনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জনসচেতনতা যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ও অন্যতম শর্ত ও হাতিয়ার। এই জনসচেতনতা বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের প্রধান থেকে শুরু করে একজন দিনমজুরের সচেতনতা। অর্থাৎ, প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা। সব নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে একটা স্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং সেটা প্রথমত নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত করার মধ্য দিয়েই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, মানুষমাত্রই নিজে ও পরিবারের সদস্যদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার, বেঁচে থাকার অক্লান্ত পরিশ্রমে লিপ্ত হয়। ফলে কিছু ব্যতিক্রমের মাঝেও ব্যক্তিমাত্রই সচেতন থাকে। তাকে সচেতন থাকতেই হয়। এখানে এডিস মশার বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যক্তির সচেতনতা জাগানোর অজুহাতে কামান আনার প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষত ব্যয়বহুল চিকিৎসা থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যক্তিমাত্রই নিজেকে সুরক্ষিত করার প্রয়োজন বোধ করে। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দিনে দিনে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাব্যবস্থা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের ও সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। চিকিৎসাব্যবস্থা এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে অসচ্ছল ও সীমিত আয়ের মানুষ নিজ উদ্যোগেই সুস্থ থাকতে সচেতন হয়ে ওঠে এবং উঠছে।

এডিস মশার আবির্ভাব কম দিনের নয়। অর্থাৎ, ডেঙ্গুর সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় বহুদিনের। কীভাবে এই রোগ সংক্রমিত হয়, বিস্তার লাভ করে, তা কিন্তু এ দেশের মানুষ জেনেছে। হতে পারে সেটা নিজ অভিজ্ঞতায় কিংবা প্রচারমাধ্যমের প্রচারণায়। অতিমারি কোভিড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজ’ বা ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সে’ কিন্তু প্রায় প্রত্যেক মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এখানে জনসচেতনতার কথা যতটা প্রচার পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মৃত্যুভয় মানুষকে পেয়ে বসেছিল। ঠিক একইভাবে ডেঙ্গু বিষয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা তাকে সেইভাবে পরিচালিত করে। কিন্তু সমস্যা হলো, কোভিড অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হয়, যা চোখে দেখা যায় না এবং যার বৈশিষ্ট্য এখনো বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ডেঙ্গু রোগ এডিস মশার কামড়ে বিস্তার লাভ করে, এটা আবিষ্কৃত। ফলে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার পরিকল্পনা, আয়োজন, আর্থিক বরাদ্দ বহুদিনের। সেলিব্রেটিদের সঙ্গে নিয়ে সিটি মেয়রদের ঝাড়ু হাতে সড়ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছবিটাও পুরোনো। এডিস মশা নিধনে প্রতিবছর সিটি করপোরেশন যে কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ করে, সেখানে অনিয়মের ঘটনাও পুরোনো। মশার স্প্রে নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা গোপন নেই। যা হোক, সিটি করপোরেশন এর বিরোধিতা চাইলেই করতে পারে, কিন্তু তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের দায় এড়াবে কীভাবে? কী কী কাজ করেছে সিটি করপোরেশন এডিস মশা নির্মূলে, তারই বা জবাব কী? জনসচেতনতা জরুরি, এমন প্রচারণার কাজই কি শুধু সিটি করপোরেশনের ছিল? সম্ভবত না। আমরা যত দূর জানি, এডিস মশা নিধনে বহু পরিকল্পনা ছিল এবং আছে। শুনেছি, বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া, ড্রোনের মাধ্যমে এডিসের প্রজননস্থল শনাক্ত করাসহ 
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কত কর্মকাণ্ডই না করা হলো। সবটাই যেন প্রদর্শনযোগ্য ছিল, কার্যকর ছিল না।

পথেঘাটে ময়লা-আবর্জনা, সড়ক খননে বৃষ্টির পানি জমে থাকা, ড্রেনেজের অব্যবস্থাপনা, নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা ময়লা পানি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে এডিস মশার অস্তিত্ব ও বংশবৃদ্ধি রোধ করা আদতে কার ওপর বর্তায়, সে বিষয়ে ততটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কেবল বাসাবাড়িতে এডিস মশার অস্তিত্ব অনুসন্ধানে অভিযান চলেছে এবং জরিমানার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এতে ধারণা হয়েছে যে, মানুষ প্রাণীর মতোই এডিস মশা বাসাবাড়িতে বসবাস করে। সম্ভবত সে কারণে জনসচেতনতার জন্য এতটা তাগাদা।

একজন প্রবীণ বলছিলেন, জনগণের ওপর দায় চাপানো কিংবা জনগণ অসচেতন—এই দোহাই-অজুহাতে অনেকেই তার দায়িত্ব ও দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ খোঁজে। বহাল তবিয়তে থাকে। প্রচার-প্রচারণা দেখলে সেটাই মনে হয়। কখনো কি দেখা যায় যে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও দায়ের বিষয়ে কোনো প্রচারণা চালাতে? দেখা যায় না। কারণ কী? কারণ হলো, দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব পালনকে দৃশ্যমান করা যায় না, যেহেতু তাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালনই করেন না। প্রবীণের কথার উত্তর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলেরাই দিতে পারেন। তবে এডিস মশা নিধনে দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশন কী কাজ করেছে, কী করতে পারেনি, তার একটা প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ পাওয়া জরুরি। এতে সিটি করপোরেশনের ওপর জনগণের আস্থা ও ভরসা তৈরির সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি এডিস মশা নিধনে প্রকৃত উপায় উদ্ভাবনের সম্ভাবনা ও স্বচ্ছতা সৃষ্টি হবে।

পরিশেষে বলব, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের চিকিৎসাব্যবস্থার চেয়ে ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশাকে নিধনের ব্যবস্থা নেওয়া অতীব জরুরি। কারণ, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এমনিতেই কমে যাবে। কেন পারছি না এডিসকে রুখতে? এডিস কি মানুষের চেয়েও বেশি শক্তিশালী কিংবা বুদ্ধিসম্পন্ন অথবা কৌশলী? নাকি সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্ত আমরাই দুর্বল থাকছি এডিসের কাছে? এডিসকে উন্মুক্ত করছি? আসুন না, জনসচেতনতার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের কথা বলি। আত্মশুদ্ধির পথটা উন্মোচন করি। পারি তো, তাই না?

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপল ইসরায়েল, তেহরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি থেকে বিদায় নিচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত