Ajker Patrika

ইসলামের আলোকে নাগরিক অধিকার

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ
ইসলামের আলোকে নাগরিক অধিকার

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘জনগণের শাসক তাদের তত্ত্বাবধায়ক, তাদের সার্বিক বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি) এই হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলারগণ বলেন, জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দশম শতকের প্রখ্যাত মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইমাম মাওয়ারদি (রহ.) ‘আল আহকামুস সুলতানিয়্যাহ ওয়াল ওয়ালায়াতুত দিনিয়্যাহ’ গ্রন্থে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা আলোচনা করেছেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধিকারের কথা তুলে ধরা হলো:

ন্যায়বিচার: জনগণের বিবাদ-বিসংবাদ নিরপেক্ষভাবে বিচার-মীমাংসা করে দেওয়া এবং অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা নবী দাউদ (আ.)-কে বলেন, ‘হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা বানিয়েছি, সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করো এবং খেয়ালখুশির অনুগামী হয়ো না।’ (সুরা সোয়াদ: ২৬) অন্য আয়াতে বলেন, ‘যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করবে।’ (সুরা নিসা: ৫৮)

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের আগের জাতিসমূহ ধ্বংস হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, যখন তাদের উচ্চবংশীয় কেউ চুরি করত, তখন তার বিচার হতো না, কিন্তু যখন দুর্বল শ্রেণির কেউ চুরি করত, তখন তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা হতো। সেই সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও কোনো দিন চুরি করে, আমি তার হাত কেটে দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম) ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলি (রা.)-এর শাসনামলে একজন অমুসলিম নাগরিকের করা মামলায় বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন খলিফা। অভিযোগ খণ্ডন করতে না পারায় বিচারপতি কাজি শুরাইহ খলিফার বিরুদ্ধে রায় দেন। (হিলইয়াতুল আউলিয়া) 

বাক্‌স্বাধীনতা: সরকার যদি আইনবহির্ভূত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার বিরোধিতা করার অধিকার আছে সর্বস্তরের জনগণের। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) তাঁর অভিষেক ভাষণে বলেন, ‘যদি আমি ঠিক পথে থাকি, তাহলে আমাকে সহযোগিতা করবেন; আর যদি আমি ভুল পথে পা বাড়াই, তাহলে আমাকে শুধরে দেবেন।’ (তারিখুত তাবারি) 

চলাফেরার স্বাধীনতা: বাজার, চলাচলের পথ, তীর্থস্থান ও পর্যটন স্পটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে সব শ্রেণির নাগরিক জানমালের কোনোরূপ ক্ষতি ছাড়া জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এবং নিরাপদে দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করতে পারে। 

নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করে সার্বক্ষণিক রাষ্ট্রের সীমানা সুরক্ষিত রাখা, যেন বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রের মুসলিম-অমুসলিম সব নাগরিক এবং বিধিসম্মতভাবে অবস্থান করা সব ভিনদেশি নাগরিক সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যয়ভার সরকার বহন করবে। 

সম্পদ যথাযথভাবে হস্তান্তর: আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের এই মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন যে তোমরা আমানত (প্রাপ্য অধিকার) হকদারদের কাছে সোপর্দ করে দেবে।’ (সুরা নিসা: ৫৮) রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ তাআলা জনগণের শাসক বানিয়েছেন, সে যদি জনগণের সম্পদে দুর্নীতি করা অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) 

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা: জনগণের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া এবং সার্বক্ষণিক তাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা, যেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে। ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে জনতার উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘আমি আমার প্রশাসকদের এ জন্য নিয়োগ দিইনি যে তারা আপনাদের জীবনের আনন্দ কেড়ে নেবে এবং আপনাদের সম্পদ কেড়ে নেবে। বরং আমি তাদের নিয়োগ দিয়েছি যেন তারা আপনাদের ধর্ম ও নৈতিকতা শেখায়। কেউ যদি এর ব্যতিক্রম করে, তাহলে তাকে আমার হাতে তুলে দেবেন। আল্লাহর কসম, আমি তার বিচার করব।’ (মুসনাদে আহমদ)

রাষ্ট্রের সব শ্রেণির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার আদায় না করলে সরকার দোষী সাব্যস্ত হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারি কর্মচারী সেবাপ্রার্থীদের থেকে তার দরজা বন্ধ করে রাখবে, আল্লাহ তাআলা আকাশে তার প্রয়োজন পূরণের দরজা বন্ধ করে দেবেন।’ (তিরমিজি) 

সম্পদের সুরক্ষা: রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণের সম্পত্তি। সরকার তা থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করতে পারবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বিলাসিতার জন্য কিংবা দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজে তা ব্যয় করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বড় ধরনের কোনো কাজে ব্যয় করতে চাইলে জনগণকে জানিয়ে তা করতে হবে। অন্যথায় জনগণ বাধা দেওয়ার ও কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার রাখবে। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক দামেস্ক শহরে আড়ম্বরপূর্ণ ‘বনু উমাইয়া জামে মসজিদ’ নির্মাণ করলে জনগণ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের অভিযোগ তোলে। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সব সম্পদ জনতার সামনে উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দেন যে মসজিদ নির্মাণের সব খরচ তিনি ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে বহন করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া) 

সূত্র: আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ ওয়াল-ওয়ালায়াতুত দিনিয়্যাহ: পৃ. ১৯-২০। 

লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত