Ajker Patrika

গ্যাস খাতে সংকট সিন্ডিকেট ও অপচয়

অরুণ কর্মকার
গ্যাস খাতে সংকট সিন্ডিকেট ও অপচয়

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘকাল ধরে এই সংকট চলে এসেছে। সংকটের কারণ প্রধানত চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার ব্যবধানজনিত। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। আবার প্রতিবছর যে হারে চাহিদা বেড়েছে এবং বাড়ছে, সেই হারে সরবরাহ বাড়েনি কিংবা বাড়ছে না। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলতে থাকায় গ্যাস-সংকট বলতে গেলে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এই সংকট থেকে শিগগির মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। 

অসম্ভব এই কারণে যে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস আহরণের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণেই এটা কমছে। কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস উত্তোলন করার ফলে ভূগর্ভে গ্যাসের যে আধার (রিজার্ভার) তার চাপ (প্রেশার) কমতে থাকে। ফলে উত্তোলনও কমতে থাকে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উন্নয়ন করে উৎপাদনে এনে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। উৎপাদনের হার ঠিক রাখতে হয়। কিন্তু বিগত সরকারের ভুল নীতির কারণে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। ফলে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন ২৭৫ কোটি (২৭৫০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা কমতে কমতে এখন প্রতিদিন ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুটে নেমে গেছে। 

অন্যদিকে ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তারও সক্ষমতা সীমিত। দৈনিক সর্বোচ্চ ১১০ কোটি (এক হাজার ১০০ মিলিয়ন) ঘনফুট। অর্থসংকটের কারণে সব সময় এই পরিমাণ এলএনজি আমদানি সম্ভবও হয় না। সারা বছর দৈনিক ১১০ কোটি ঘনফুট হিসাবে এলএনজি আমদানি করতে হলে এই খাতে বছরে কম-বেশি ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে এখন প্রতিদিন গ্যাসের ন্যূনতম চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে ৩০০ কোটি ঘনফুটের কম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এই পরিমাণ ১০-২০ কোটি ঘনফুট বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। তার বেশি নয়। 

এই সংকটের মধ্যেও দেশে গ্যাসের অপচয়ের চিত্র ভয়াবহ। গ্যাস-সংকটের পাশাপাশি এই অপচয়ও দীর্ঘকাল ধরে চলে এসেছে। কখনো তা কিছুটা কমেছে। কখনো আবার বেড়েছে। এই অপচয়ের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস ব্যবহার। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিদ্যমান লাইন ব্যবহার করা ছাড়াও শত শত কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে অবৈধ গ্যাস-সংযোগের রমরমা বাণিজ্য চলে এসেছে। এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সিন্ডিকেট। 

গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেয়। তবে কখনোই তা শতভাগ সফল হয় না ওই দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যের কারণে।

সংঘবদ্ধভাবে তারা কোম্পানির লোকদের ওপর হামলা চালায়। তারপরও যেসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় সেগুলোও অনতিবিলম্বে তারা পুনস্থাপন করে নেয়। এইসব অবৈধ গ্যাস-সংযোগ থেকে প্রতি মাসে ওই দুর্বৃত্তরা বিপুল অর্থ উপার্জন করে। আর অসহায় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো ওই অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে ব্যবহৃত গ্যাস তাদের ‘সিস্টেম লস’-এর হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট ভাঙার একটি অতিপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। তার সঙ্গে অবৈধ গ্যাস-সংযোগের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটটি যুক্ত করা হলে রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ ও অর্থ সাশ্রয় হবে। 

গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর কিছু হিসাব থেকে এই সাশ্রয়ের পরিমাণ সম্পর্কেও আমরা একটি ধারণা পেতে পারি। দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস বিতরণ করা হয় তার প্রায় ৫৫ শতাংশ বিতরণ করে তিতাস। ঢাকা মহানগরীসহ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ প্রভৃতি বিস্তৃত অঞ্চল এই বিতরণ কোম্পানির আওতাধীন। এর প্রতিটি এলাকায় হাজার হাজার আবাসিক এবং শত শত বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ রয়েছে অবৈধ। ফলে তিতাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশ। অথচ পুরোনো পাইপলাইন এবং অন্যান্য কারিগরি কারণে এই সিস্টেম লস ২ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। 

কোম্পানির হিসাব বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, তিতাসের ৭ শতাংশ সিস্টেম লস মানে হলো প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা। বছরে ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। তিতাসের সঙ্গে অন্য পাঁচটি কোম্পানির সিস্টেম লসের আর্থিক মূল্য যুক্ত করলে তা মোট বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এই বিপুল অর্থের প্রায় সবটাই যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের পকেটে। বিতরণ কোম্পানিগুলো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। 

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, গত বছর (২০২৩ সাল) দেশে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোট ১৮৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ২৬৫টি চুলা এবং সাতটি শিল্পগ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর ফলে দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সোয়া লাখ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। শিল্প খাতের ৭৪টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর ফলে দৈনিক ১ কোটি ৪১ লাখ টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। তিতাস গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত শুধু কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ৬৭টি অবৈধ শিল্প-সংযোগসহ মোট ৫ হাজার ২৯৪টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু এসব সংযোগ কত দিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাধারণত বিচ্ছিন্ন করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সংযোগগুলো পুনঃস্থাপিত করে নেওয়া হয়। এই প্রবণতা রোধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক নেতাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা গেলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। 

অবৈধ সংযোগ ছাড়াও শিল্পকারখানায় অদক্ষ বয়লারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির কারণেও বিপুল গ্যাসের অপচয় হয়। আমাদের দেশের সার কারখানা এবং অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রও জ্বালানিসাশ্রয়ী নয়। ফলে সেগুলোতেও বিপুল গ্যাসের অপচয় হয়। জ্বালানিসাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন করে এই অপচয় রোধ করা প্রয়োজন। এ কথা মনে রাখা দরকার যে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে যেমন গ্যাসের মজুত বাড়ানো যায়, তেমনি অপচয় রোধ করা গেলেও মজুত সংরক্ষণ করা যায়, যা নতুন আবিষ্কারের নামান্তর। 

তাই দেশের দীর্ঘকালীন জ্বালানি-সংকট নিরসনের জন্য নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান করা, এই খাতের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করা এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী সব শিল্পকারখানা, সার কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রভৃতিতে জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার কাজ একযোগে চালাতে হবে।

লেখক: অরুণ কর্মকার
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত