Ajker Patrika

নির্বাচন কমিশন, বিএনপি এবং জাফরুল্লাহ সমস্যা

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২২, ০৯: ৪৯
নির্বাচন কমিশন, বিএনপি এবং জাফরুল্লাহ সমস্যা

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। অন্য চার নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পেয়েছেন জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর, আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান। শপথ গ্রহণের পর নতুন কমিশন কার্যভারও গ্রহণ করেছে। এই কমিশনের অধীনেই দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে কমিশন কাজ শুরু করেছে।

এবারই প্রথম আইনের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করা হলেও এই কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক আছে, পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। রাষ্ট্রপতি আইন অনুযায়ী একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিলেন। ছয় সদস্যদের অনুসন্ধান কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। তাঁদের কাছ থেকে নাম নিয়েছে, পরামর্শ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তিন শতাধিক নাম থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০ জনের নাম অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার পর সেখান থেকেই ৫ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তবে শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ার বাইরে আছে সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। বিএনপি আছে বর্জন-প্রক্রিয়ায়। দলটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা বর্জন করেছে। অনুসন্ধান কমিটি বর্জন করেছে। কমিশন গঠনের জন্য নাম প্রস্তাব করাও বর্জন করেছে। কমিশন গঠনের পর তা নিয়ে মন্তব্য করাও বর্জন করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁদের মাথাব্যথা নির্বাচন কমিশন নিয়ে নয়, তাঁদের মাথাব্যথা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে।

বিএনপির এই মাথাব্যথা দূর হওয়ার আশু কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আবার সরকারও নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে তাদের শক্ত বিরোধী অবস্থানের কারণে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানই বাতিল করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এটাই বিধান যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, সেই সরকারের অধীনে এবং নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানেই আগামী নির্বাচন হবে। বিএনপি খোয়াব দেখছে সরকার পতনের। সরকার পতনের সময় নাকি এসে গেছে! এই খোয়াবনামা অবশ্য বিএনপি বছরের পর বছর ধরে বয়ান করে চলেছে।

বিএনপি সবকিছু বর্জনের ধারায় থাকলেও তাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে সংলাপে বিএনপি-দরদি আরও কয়েকজনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। তিনি সেখানে তাঁর নানা পরামর্শ দিয়েছেন, পছন্দের ৮ জনের নামের তালিকাও দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর জানা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম ছিল ডা. জাফরুল্লাহর তালিকায়। তাঁর তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিএনপিকে অনুরোধ করেছেন তারা যেন নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেয়।

নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে ডা. জাফরুল্লাহর ভূমিকায় বড় বিপাকে পড়েছে বিএনপি। ডা. জাফরুল্লাহ যে তাদের লোক নন, তাঁকেও যে বিএনপি বর্জনের তালিকায় তুলেছে, নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে তা দলটি প্রকাশ করেনি। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করায় এবং বিএনপিকে অবস্থান পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করতে পারেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় কিন্তু বিএনপিকে কোনো মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তিনি বিএনপির কেউ নন।’

তাহলে তিনি কার? এত দিন যে বিএনপির সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ তাদের হয়ে সরকারের মুণ্ডুপাত করে আসছেন, সেটা বিএনপি কেন মেনে নিয়েছে? তখন তাঁকে বর্জনের প্রশ্ন আসেনি কেন? এক নির্বাচন কমিশন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পছন্দের মিল হওয়ায় বিএনপি তাঁকে বর্জন করল? তাহলে কেউ কেউ যেটা মনে করেন, বর্তমান সরকারের কট্টর সমালোচক হওয়ার গুণেই তিনি বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীর তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন, সেটাই সত্য? ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই তত্ত্ব মেনে বিএনপি তাঁকে কোলে তুলে নেচেছিল?

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে জোট গঠিত হয়েছিল, তার পেছনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বড় ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে মিলে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় ঘটার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিষ্ক্রিয় দেখা যায়নি। তিনি তাঁর অবস্থানও বদলাননি। তিনি নিয়মিতভাবে সরকারবিরোধী নানা অনুষ্ঠানে সরব আছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে একটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় সহায়তা দিয়ে একটি ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করায় তাঁর প্রতি অনেকেরই সহানুভূতি, সমর্থন ও দুর্বলতা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে পছন্দ করতেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য জমি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটিও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া। অথচ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চরম বিরূপতা রয়েছে। অবশ্য ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেকে শেখ হাসিনারও শুভানুধ্যায়ী বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা না গেলেও শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর সব সরকারের শুভানুধ্যায়ীর ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেছে। দেশের দুই সেনাশাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। এরশাদ আমলে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন করে তিনি গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মহলে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছিলেন।

নিরপেক্ষ অবস্থানের নামে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেক সময় এমন সব কথা বলেন, যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি একদিকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে গর্ব করেন, অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের পক্ষে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সমালোচনায় তিনি নির্দয় হলেও বিএনপির সমালোচনায় খুবই সদয়। তিনি কখনো কখনো বিএনপিকে যেসব পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তার কোনোটাই বিএনপি শোনার গরজ বোধ করে না। তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সমালোচনা করে এবং তারেক-কন্যা জাইমাকে বিএনপির রাজনীতির জন্য প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বিএনপির কিছুটা বিরাগভাজন হয়েছেন। কিছু দিন আগে বিএনপির নেতাদের ‘চাকর-বাকর’ বলেও তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন। কিন্তু সবশেষে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের প্রতি আস্থা পোষণ করে প্রকাশ্যে কথা বলে বিএনপির কাছে বোঝা হয়ে উঠেছেন। এই ‘বোঝা’ বিএনপি আবার ঘাড়ে তুলে নেবে কি না, সেটাই 
এখন দেখার বিষয়।

তবে আওয়ামী লীগের পছন্দের নির্বাচন কমিশনের বিরোধিতা করে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে বিএনপি শেষ পর্যন্ত 
অটল থাকলে কী হবে? বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সরকার তথা আওয়ামী লীগ কি নমনীয় হবে, ছাড় দেবে? সরকার কি আসলে অবস্থান বদল করার মতো বিশেষ কোনো চাপে আছে?

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে অনেক কথা বলছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা বলেছেন তা হলো, ভোটের মাঠে নির্বাচন কমিশন একা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পারে না। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অসীম নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দরকার।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে, তাহলে সিইসি হিসেবে তিনি মুরব্বির ভূমিকা নিতে পারবেন না।

কিন্তু রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হওয়ার কোনো লক্ষণ কি কেউ দেখছেন? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, আবারও ক্ষমতায় ফিরতে চায়। বিএনপি আছে ক্ষমতার বাইরে, ফিরতে চায় ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থেকে চাওয়া আর ক্ষমতার বাইরে থেকে চাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রার্থক্য আছে। এই প্রার্থক্য দূর করার জাদুর কাঠি কি কারও সন্ধানে আছে?

লেখক:বিভুরঞ্জন সরকার,সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত