Ajker Patrika

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

মাসুদ রানা
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

বাংলাদেশে কয়েক বছরের মধ্যে নতুন এক ব্যবসায়িক শ্রেণির অপতৎপরতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। যাদের ক্ষমতা অনেক বিস্তৃত। রাষ্ট্র ও সরকারও যেন তাদের কাছে অসহায়। বিষয়টি আসলে সে রকম নয়। সে বিষয়ে পরে আসছি।

তারা রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণকে নিছক ‘পণ্য’ হিসেবে গণ্য করে থাকে। যদিও অর্থনীতির ভাষায়, পণ্যের বিনিময় মূল্য থাকে। কিন্তু উল্টোভাবে সাধারণ জনগণের পকেট খসিয়ে থাকে তারা।

অর্থনীতিবিদেরা তাদের নাম দিয়েছেন—ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অথবা বিভিন্ন পণ্য গুদামজাত করে সাধারণ জনগণকে বিপাকে ফেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এতে সাধারণ জনগণ বাধ্য হয়ে বলির পাঁঠা বনে যান। আর ব্যবসায়ীরা কয়েক দিনের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা লাভ করে থাকেন।

আমরা ছোটবেলায় বয়স্কদের কাছে শুনতাম ব্যবসার নীতি, আদর্শের কথা। যেমন—ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রেতা হলেন লক্ষ্মীর বা দেবতার মতো। কিন্তু সে কাল গত হয়েছে। এসব ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সময়। আমরা তো এখন পুঁজির জমানায় বাস করছি। আর তাই ক্রেতারা হলেন এখন তাঁদের কাছে মুনাফা করার যন্ত্র যেন।

করোনাকালে আমরা যেমন তাঁদের রূপ দেখেছি, তেমনি করোনার পরেও তাঁদের তৎপরতা এতটুকু কমেনি। সে সময় একটা পাঁচ টাকার মাস্ক ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। এরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা অক্সিজেন সিলিন্ডারের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। একটা প্রকৃতি-সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিকালেও তাঁদের বিবেক, মানবতা লোপ পেয়েছিল। যখন মানুষের কাছে মৃত্যু খুব সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ছিল। হায় ব্যবসায়ী! হায় মুনাফা!

করোনা পরবর্তীকালে পেঁয়াজ দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের মুনাফা লুটের যাত্রা। এরপর একে একে সয়াবিন তেল, ডিম, চালসহ সর্বশেষ লাল আটা, চিনি আর গুঁড়ো দুধে গিয়ে ঠেকেছে তাঁদের সীমাহীন লোভের হাত। ভবিষ্যতে আরও কত কিছু দ্বারা যে সাধারণ মানুষ বলির পাঁঠা হবে, এ কথা আপাতত বলা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সংকটের শুরু হয়েছিল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর কারণে। যে অবস্থা এখনো বিরাজমান।

প্রতিবছর বাজেট এবং রোজা শুরুর আগেই ব্যবসায়ীদের প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি করার নিয়ম যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

এই অত্যাচারের মহোৎসব থেকে নাগরিকদের মুক্ত করতে সরকার যে কোনো তৎপরতা দেখায় না, তা নয়। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার নজরদারি করে। কিন্তু তাদেরও কোনো কার্যকর ভূমিকা জনগণের কাজে আসে না।

২০১২ সালে ব্যবসায়ে কারসাজি নিয়ন্ত্রণে ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ সংসদে পাস হয়েছিল। বাজারে পণ্যের অযৌক্তিক দাম বাড়ানো এবং বাজার অস্থিরতার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং তাদের অপতৎপরতা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

প্রশ্ন হলো, সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে এতটা নতজানু কেন? রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের টাকা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় চলে, সেটি নতুন নয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন শুধু আড়ালে থাকছেন না, সরাসরি রাজনীতির মাঠেই নেমে পড়েছেন। তাঁরাই আইন প্রণয়ন করছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক করছেন, সরকার চালাচ্ছেন।

স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সাড়ে ১৭ ভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী। ১৯৯১ সালে যা বেড়ে ৩৮ ভাগে দাঁড়ায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনের পেশা ব্যবসা। মোট সংসদ সদস্যের যা ৬২ শতাংশ। বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে আছেন ব্যবসায়ীরা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় তাঁদের কাছে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধান্য পাবে—সেটি বলাই বাহুল্য।

সরকারের ওপরমহল থেকে জনগণকে শুধু সাশ্রয়ী আর সাবধান হওয়ার ঘোষণা দিলেই চলবে না, পাশাপাশি নিত্য খাদ্যপণ্য নিয়ে কারসাজি রোধে আরও কঠোর হতে হবে। যেসব অসাধু ব্যবসায়ী অতিমুনাফার জন্য সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন, বাজারে প্রকৃত তদারকির মাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত