Ajker Patrika

বিদ্যুতে ভুগছে মানুষ

সাজ্জাদ হোসেন ও আবির হাকিম, ঢাকা
বিদ্যুতে ভুগছে মানুষ

বিদ্যুতের অভাবে নাকাল হচ্ছে মানুষ। সারা দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলছে লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও এটা ১৮-২০ ঘণ্টায় পৌঁছে গেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাপমাত্রা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আপাতত সম্ভাবনা নেই বলে গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এই অবস্থায় আলোচনা হচ্ছে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে আগামীকাল বৃহস্পতিবার।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বৃহস্পতিবার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে উৎপাদন খাতে ডিজেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে একদিকে খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে কারখানা পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতায় চালাতে না পারার কারণে আর্থিক ক্ষতি বেড়ে গেছে। তাঁর মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে সরকারের উচিত পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা। 

লোডশেডিংয়ের হালচাল

গ্যাস ও তেলের আমদানি ও সরবরাহ কম থাকায় সরকার অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। চলতি মাসের ৪ তারিখে গ্রিড বিপর্যয়ের পর কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় সচল করতে না পারার কারণেও বেড়েছে লোডশেডিং। ঢাকাতে তিন-চার ঘণ্টা এবং গ্রামে সাত-আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের তথ্যমতে, গতকাল মঙ্গলবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৮৬৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের সর্বনিম্ন উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট। 

দেশব্যাপী বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং দেখানো হয় ১ হাজার ২২০ মেগাওয়াট। পিডিবির দুজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, গতকাল দেশব্যাপী লোডশেডিং করা হয় ৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।

ঢাকার একাংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী আজকের পত্রিকাকে জানান, বিদ্যুতের অভাবে তাঁর এলাকায় দিনে তিন-চার ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। গভীর রাতেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ফেনীর ফুলগাজী থেকে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি জানান, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রতিদিনই গড়ে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকে। বিদ্যুৎ না থাকায় ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কাজই করতে পারছে না।

পানিসংকট

সারা দেশে লোডশেডিং বাড়ায় রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহে মারাত্মক সংকট চলছে। অতিরিক্ত গরমের সঙ্গে পানির সংকট দেখা দেওয়ায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। 
পানির সংকটের কারণ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় রাজধানীর কিছু জায়গায় চাহিদামতো পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার চলতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াকেও কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে ওয়াসা। তবে বিদ্যমান অবস্থায় রেশনিং করে পানি সরবরাহ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে পানির সংকটে ভুগছেন তাঁরা। এ সপ্তাহে কোনো শিডিউল ছাড়াই যখন-তখন লোডশেডিংয়ের কারণে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

খিলগাঁও এলাকার বাড়ির মালিক আবদুল করিম গ্রাহকের অভিযোগ, ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ে, হটলাইনে কিংবা সশরীরে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। 
ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (টেকনিক্যাল) এ কে এম সহিদ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টিপাত ৬০ ভাগ কম হয়েছে। এর সঙ্গে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পাম্প ও প্ল্যান্টগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। 

তাপমাত্রা কমার আশায় সরকার

তাপমাত্রা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আপাতত সম্ভাবনা নেই বলে গতকাল মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। লোডশেডিং নিয়ে আপাতত কিছুই করার নেই জানিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তাপমাত্রা কমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।

লোডশেডিং করাতে বাধ্য হয়েছেন জানিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কালকে আমার বাড়িতেও রাত ২টার পরে বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা সবাই তো এক সঙ্গে। আমি বলব, একটু ধৈর্য ধরেন।’

দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় যে বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে না। খারাপের দিকে যাচ্ছে এটা সত্যি কথা, তবে বেশি খারাপের দিকে না।’

দাম বৃদ্ধির আলোচনা

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিইআরসির কাছে। প্রস্তাবে বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি তুলে দিয়ে দাম বাড়ানোর কথা বলা হয় হয়। বর্তমান দর ইউনিটপ্রতি ৫ দশমিক ১৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবের ওপর কয়েক দফা শুনানি শেষে গত ১৮ মে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে জ্বালানি খাতের দাম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার বিদ্যুতের পাইকারি এবং খুচরা দাম একসঙ্গে বাড়ায়। তখন প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য ৫ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও পাইকারি দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ বছরে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, সরকার সারা দেশে ঠিক মতো বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। এই অবস্থায় দাম আবার বাড়ানো হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম থেকে সার্বিক জীবনযাপনে অস্থিরতা বাড়বে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে শিল্পের অবস্থা এমনিতেই খুবই খারাপ। একদিকে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুতের ঘাটতি পোষাতে ডিজেলে চালাতে গিয়ে অনেক টাকা গুনতে হচ্ছে। এর ফলে উৎপাদন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এখন যদি সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় তাহলে আমরা কি ব্যবসা বন্ধ করে দেব?’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত