Ajker Patrika

জবাবদিহি নেই

নুসরাত জাহান শুচি
আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪: ৫৭
জবাবদিহি নেই

আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বোর্ড পরীক্ষা, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সব মিলিয়ে ছয়খানা কাগজ পেয়েছিলাম। অর্থাৎ আমার পরিচয়মূলক কিছু সনদ আরকি, যার দ্বারা আমার পরিচয় বহন করা হবে। তাই যদি কিছু ভুল হয়ে যায় তাহলে চাকরি, পাসপোর্ট বা পড়াশোনা কোনো ক্ষেত্রেই আমার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কিন্তু এই ছয়টি সনদে এখন পর্যন্ত আমি সাতবার বানানের ভুল ঠিক করিয়েছি।

আর বানান ঠিক করা বললেই তো ঠিক করা নয়। কেবল সনদে একটি নামের বানান ঠিক করার জন্য এক বছরের বেশি সময় রাজশাহী বোর্ডে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে মানসিক আর আর্থিক বিষয়টা বাদই দিলাম। শুধু তা-ই নয়, এক পরীক্ষার আগে এসব বানানসংক্রান্ত জটিলতায় তো অ্যাডমিট কার্ডই হাতে পেয়েছিলাম পরীক্ষার আগের দিন। নিশ্চয়ই আমার মতো অনেকেই এ রকম জটিলতায় পড়েছেন।

যাক সেসব কথা। এবার জাতীয় পরিচয়পত্রের কথায় আসা যাক। এ ক্ষেত্রে বোধ করি বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের সমস্যা থাকে। কিন্তু কেন এ সমস্যা? পরিচয়পত্রের জন্য যখন নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়, তখন কর্তব্যরত ব্যক্তি বানানের তোয়াক্কা না করেই মনগড়া বানান বসিয়ে দেন। কারণ, তিনি জানেন সবগুলো নামের বানানও যদি তিনি ভুল করেন, তবু তাঁর বিশেষ কিছু হবে না। না তাঁর চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয় আছে, না কোথাও জবাবদিহি করতে হবে।

তবে এই পরিচয়পত্র ঠিক করতে প্রতিটি ভুলের জন্য ভুক্তভোগীকে ক্ষেত্রবিশেষে ১১৫, ২৩০, ৩৪৫ বা কখনো ৪৬০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। প্রয়োজনীয় সময়ে পাসপোর্ট করতেও আগে সংশোধনীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

খুব বেশি শক্ত কাজ তো এটি নয় যে নির্ভুল করা সম্ভব নয়। জবাবদিহির অভাবই কি এর একমাত্র কারণ নয়?

বিশ্বের সব উন্নত দেশের বেশির ভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় বেসরকারিভাবে বিভিন্ন করপোরেট অফিস বা প্রজেক্টের মাধ্যমে। যেখানে সময়, খরচ এবং যথার্থ ফলাফল—সব বিষয়েই জবাবদিহির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। কোনো ভুল বা অন্যায়ের জন্য তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হবে—এমন দৃষ্টান্তও বিরল। তাই ইচ্ছামতো যা কিছু করা যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেনি। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বা না বুঝেই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে ইদানীং। বেশি দিন আগের কথা নয়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম ধর্মকে সামনাসামনি নিয়ে এসে উসকানিমূলক একটি উদ্দীপক রচনা করা হলো। এরপর আলোচনা-সমালোচনা হলেও দুই মাস পার হওয়ার আগেই আবারও স্কুলের বইয়ে ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে বলছেন অনেকে। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর প্রতি আগেই নজর দেওয়া জরুরি ছিল।

বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু অনুবাদ করা হয়েছে, যাকে বলা হয় প্লেজারিজম, যা আইনত অপরাধ। বইটির সম্পাদক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যদিও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এতেই কি দায়িত্ব শেষ? যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ হুমকির দ্বারপ্রান্তে, সেখানেও নেই জবাবদিহি।

আমাদের দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান দখল করতে পারছে না। অথচ সম্প্রতি নতুন আরও ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমছে শিক্ষার মান। কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই।

ভোগান্তি বাড়ছে। সাধারণ জনগণ ভুলেই গেছে ভোগান্তি ছাড়াও কোনো কাজ করা সম্ভব। এটিকে নিত্যসঙ্গী বা জীবনের অংশ ধরে নিয়েই চলছে তাদের জীবন। কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই!

লেখক: নুসরাত জাহান শুচি, সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত