Ajker Patrika

লেখক, পাঠক, প্রকাশক

সাজিদ মোহন
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯: ২৬
লেখক, পাঠক, প্রকাশক

বইমেলার কয়েক মাস আগে এক প্রকাশককে ফোন করে জনৈক লেখক বললেন, ‘ভাই, সামনে তো বইমেলা। পাণ্ডুলিপি তৈরি করা আছে। কীভাবে কী করা যায় বলেন।’ প্রকাশক জানতে চাইলেন, ‘বইয়ের ভেতরে ছবি আঁকা লাগবে, নাকি শুধু প্রচ্ছদ?’ যেহেতু ছোটদের বই, জনৈক লেখক বললেন, ‘ভেতরে আটটি গল্পের জন্য আটটি ছবি আঁকতে হবে আর চার রঙা প্রচ্ছদ।’ প্রকাশক জানালেন, প্রচ্ছদ ও ভেতরে আটটি ছবির জন্য শিল্পীকে দিতে হবে ৭ হাজার টাকা। ছয় ফর্মা বইয়ের দাম পড়বে ২৪০ টাকা। শতকরা ৫০ ভাগ কমিশনে ২০০ বই কিনতে হবে ২৪ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে ৩১ হাজার টাকা দিতে হবে প্রকাশককে।

প্রকাশকের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইলেন জনৈক লেখক। বইটা লিখতে বাংলাদেশ-কলকাতা মিলিয়ে সহায়ক বই কিনতে হয়েছে ৫ হাজার টাকার। সময় লেগেছে প্রায় এক বছর।

ব্যক্তিগতভাবে লেখালেখি ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কল্যাণে দেখেছি, প্রতিবছর বইমেলার আগে প্রকাশকের অফিসে হাজির হন একদল লোক। প্রকাশকের ভাষায় ‘মুরগি লেখক’। এঁরা মূলত মূলধারার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত নন। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ ও নিজের ওয়ালে কবিতা, ছড়া, গান, গল্প, মুক্তগদ্য ও স্ট্যাটাস লেখেন। বইমেলা এলে এঁদের মনে বই প্রকাশের ইচ্ছে জাগে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রকাশকের সঙ্গে বই কেনার চুক্তি করেন। এদের কারও কারও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে ভবিষ্যতে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি সুবিধা লাভের আশায় প্রকাশক বিনা মূল্যে বই করে দেন।

বইমেলার স্টলগুলোর সামনে গেলে এঁদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। এঁদের অনেকে স্টলের ভেতরে ও বাইরে ঘাপটি মেরে বসে-দাঁড়িয়ে থাকেন ‘খদ্দের’-এর অপেক্ষায়। পরিচিত কাউকে পেলেই ছুটে এসে অর্থের বিনিময়ে গছিয়ে দেন নিজের একটি বই। ‘মৌসুমি লেখক’দের মধ্যে যাঁরা বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্থবিত্তের মালিক, বই তাঁদের কাছে আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁদের লেখা বইগুলো বিনা মূল্যে বিতরণ করেন বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, বিশিষ্টজন ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। সৌজন্য কপি দিয়ে জানান দিতে চান, তিনি একজন লেখক। তাঁকে যেন যথাযথ সম্মান ও সুবিধা দেওয়া হয়। আসলে আমাদের দেশে বেশির ভাগ লেখকই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছেই লেখক। আপামর পাঠকের কাছে তাঁরা পৌঁছাতে পারেন না। অনেকের মনে এ রকম ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, বই বিনা মূল্যে উপহার দেওয়ার জিনিস। অনেকেই লেখকের কাছে সৌজন্য সংখ্যা চেয়ে বসেন।

লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই বের করার ফলে প্রকাশকেরা তাঁদের পেশাদারি হারিয়ে ফেলেন। এ ধরনের বইগুলো সম্পাদনা ছাড়াই কোনো রকম ছাপিয়ে দেওয়া হয়। চকচকে মলাট দেখে পাঠক এই বইগুলো কিনে ফেলেন। পড়তে গিয়ে বুঝতে পারেন প্রতারিত হয়েছেন। আবার এ ধরনের বই প্রকাশের রীতি গড়ে ওঠায় প্রকাশকেরা ‘জনৈক লেখক’-এর মতো পরিশ্রমী, প্রতিভাবানদের অবমূল্যায়ন করেন। উভয় পক্ষের ভেতর বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হতে থাকে বই বের করতে হলে টাকা দিতে হবে অথবা বই কিনে নিতে হবে।

প্রতিবছর বইমেলায় বই বের হয় হাজার হাজার। পড়ার মতো বই বের হয় হাতে গোনা। তারপরও প্রচুর বই বিক্রি হয় পাঠকের রুচির ভিন্নতার কারণে। অপ্রয়োজনীয়, মানহীন এত এত বই গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃত বইগুলোর ক্ষতি করছে। পাঠকের সামনে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো সামনে আসছে না। বেশির ভাগ পাঠকই অন্ধের মতো হাতড়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অপ্রয়োজনীয়, মানহীন বই। কী বই প্রকাশ করা যাবে, কী বই প্রকাশ করা যাবে না, এসব বিষয়েও কোনো নীতিমালা নেই। কোনো মানদণ্ড নেই। বিষয়টি যেহেতু লেখালেখি, লেখকের স্বাধীনতাও খর্ব করার উপায় নেই।

এই বিশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন প্রকাশকেরা। মানসম্পন্ন বইয়ের বিক্রি বাড়ালে আমাদের প্রকাশনাশিল্পটা সত্যিকার অর্থে শিল্প হিসেবে দাঁড়াবে। তখন লেখক পাবেন যথাযথ মর্যাদা, ভালো বই পড়ে তৃপ্তি মেটাতে পারবেন পাঠক।

সাজিদ মোহন: শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত