Ajker Patrika

শিক্ষার্থীদের ‘হাজতখানা’

সাজিদ মোহন
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮: ৪৩
শিক্ষার্থীদের ‘হাজতখানা’

সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কয়েদি সেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান পর্বের শেষ দিনটি উদ্‌যাপন করার প্রতীকী ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার সৃষ্টি করেছে। একটি নির্ধারিত স্থানে তৈরি করা হয় হাজতখানা। কয়েদি নম্বরের জায়গায় স্থান পেয়েছিল শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর। তাঁদের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ছিল কয়েদিদের শোভাযাত্রা, জেলার সেজে ঘণ্টা বাজানো, কয়েদিদের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থালা হাতে খাবার খাওয়া ও কারামুক্তি ফুটবল টুর্নামেন্ট। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ‘করোনার কারণে ক্যাম্পাসে থাকলেও একরকম বন্দিজীবন কাটিয়েছি। এ জন্য প্রতীকী কয়েদি সেজে শেষ দিনটি উদ্‌যাপন করেছি।’ তাঁদের এ উদ্‌যাপনের আপাতত এ সরল ব্যাখ্যার পেছনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত কদর্যরূপটিই প্রতীকের মাধ্যমে সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে বেশ কয়জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, কাঙ্ক্ষিত ফল না করায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর শোনা যায়। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। একই বছর পিইসি ও জেএসসির ফলাফল প্রকাশের পর আত্মহত্যা করে ১৭ জন শিক্ষার্থী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছেন ১০১ জন শিক্ষার্থী।

আমাদের দেশে পরীক্ষায় খারাপ করা শিক্ষার্থীদের প্রতি অভিভাবক, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, এমনকি ‘সফল’ সহপাঠী বন্ধুবান্ধবের নীরব-সরব অবহেলা, কটূক্তি, সহিংসতা ও নিপীড়নের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতা, সেশনজটের কারণে ভবিষ্যৎ চাকরির অনিশ্চয়তা, আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, অভিমান, র‍্যাঙ্কিংয়ে হেনস্তা, অবমাননা, যৌন হয়রানি শিক্ষার্থীদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আনন্দমুখর হয়ে ওঠেনি। পাঠ্যবই, গাইড বইয়ের বোঝা, মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসা থেকে বেত্রাঘাত সহ্য করতে না পেরে মধ্যরাতে চার শিক্ষার্থীর পালিয়ে যাওয়ার মতো শত শত ঘটনা পত্রিকায় পড়েছি। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়েই শুধু এ নির্যাতন সীমাবদ্ধ নয়। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন ১৪ ছাত্রের মাথার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়ার ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে গত বছর। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও সহপাঠী কর্তৃক শরীরে আগুন ধরিয়ে হত্যা, বুয়েটের ছাত্রাবাসে সহপাঠী কর্তৃক পিটিয়ে আবরার হত্যার ঘটনা বেশি দিন আগের নয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনশনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তালেবানি কালচারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন।

এসব ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় পালিত ছাত্রসংগঠনগুলোর অন্তঃকোন্দলের ফলে মারামারি, হামলা, ভাঙচুর, হতাহত ও হত্যার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোয় শিক্ষার্থীদের খাবার নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দৈনিক একজন শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ২৮০০-৩০০০ কিলোক্যালরি। হলের খাবারে একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড় পুষ্টি পান ১৮২১ কিলোক্যালরি। এ রকম পুষ্টি পেলে তাঁকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ধরা হয়। পুষ্টি গ্রহণের বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকেই উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনব্যবস্থার কথা উঠলে সামনে চলে আসে গণরুম সংস্কৃতি। গণরুমের অবস্থা বস্তির চেয়েও খারাপ। রুমের মেঝেতে সারি সারি বিছানা আর জিনিসপত্রে ঠাসা। গণরুমে হয় না পড়াশোনা, ছারপোকার কামড়, নোংরা পরিবেশ, শৌচাগার সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ ছাড়া গণরুমের শিক্ষার্থীদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা-কাহিনী’ এই সময়েও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। মন্ত্রী রাজার নির্দেশে পাখিটাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য খাঁচা বানালেন। রাশি রাশি পুঁথি মুখের মধ্যে ঠেসে দিয়ে পাখিটাকে মারলেন। সেভাবেই ‘হাজতখানা’র রূপকের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যেন নতুনভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন কুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

সাজিদ মোহন: শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

এবার ‘পাকিস্তানপন্থার’ বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আসিফ মাহমুদ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত