Ajker Patrika

রেলের সব নিয়োগেই ভেজাল

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ৫৩
রেলের সব নিয়োগেই ভেজাল

সুকুমার দে, বয়স ৬৮ বছর। ২০১৯ সালে যখন নিয়োগ পান, বয়স ছিল ৬৫। নিয়োগ পাওয়া মো. আবুল বশর খানের বয়স ৫৫। বিজ্ঞপ্তিতে বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারিত থাকলেও এই দুজনের মতো অনেকের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। শুধু এই নিয়োগ নয়, ২০১৬ সালে ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস, ২০১৭ সালে ১৮৫ জন সিপাহি এবং ২০১৮ সালে ‘টিকিট কালেক্টর’ পদের নিয়োগেও আছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ।

রেলে সবচেয়ে বড় নিয়োগ হয় খালাসি পদে। এ পদে ৮৬৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয় ২০১৯ সালে। সেই নিয়োগ ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর তদন্তে নামেন দুদক চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন পরিচালকের কাছে জমা দেন তিনি। এরপর গত বছরের মার্চে রেলের সাবেক জিএম সৈয়দ ফারুক আহমেদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, খালাসি পদে নিয়োগ পাওয়া ৮৬৫ জনের সবাই ৫-৭ লাখ টাকা করে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এই নিয়োগ ঘিরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য পায় দুদক। এর মধ্যে ৭২ জন নিয়োগ পান জাল সনদ দিয়ে। ১০-১২ জন বয়স কারচুপি করেন। ২৫ জন নিয়োগ পান এনআইডি জালিয়াতি করে।

আজকের পত্রিকার হাতে আসা কাগজপত্রে দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া মো. আবুল বশর খান বয়স লুকিয়েছেন। রাজবাড়ীর কালুখালী এলাকার মৃত লোকমানের ছেলে তিনি। তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেন টিকিট প্রিন্টিং প্রেস কলোনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাশ ও তাঁর বড় বোনের স্বামী রেলের শ্রমিকনেতা খন্দকার সাইফুল ইসলাম। পরস্পরের যোগসাজশে ভর্তি রেজিস্ট্রার ও আগের প্রতিষ্ঠান আদর্শ কিন্ডারগার্টেন হাইস্কুলের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদ দেন মৃণাল কান্তি দাশ।

খালাসি পদে ৮৪০ নম্বর সিরিয়ালে থাকা সুকুমার দের বয়স এখন ৬৮। তিনিও বয়স কারচুপি করে নিয়োগ পান। প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে তাঁকে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমদের গাড়ির চালক হারাধন দত্ত।

নিয়োগ কমিটি ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেসার্স ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের মালিক আমিরুজ্জামান আশীষ একাই নিয়োগ দিয়েছেন ১৩ জনকে। 
তাঁদের কাছ থেকে ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এই টাকা এস এ পরিবহনের কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাঁর হাতে আসে। ঢাকার তেঁজগাও এলাকার রবিউল ইসলামের স্ত্রী পারভীন আক্তার নিয়োগ দিয়েছেন ৯ জনকে। তিনিও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঘুষের টাকা পান। ঝালকাঠির কোনাবাড়িয়া এলাকার মো. তারেক হোসেনও খালাসি পদে নিয়োগ দেন। এ জন্য ঘুষ নেন ৪১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এসব টাকা পরে নিয়োগ কমিটি ও শ্রমিক নেতাদের কাছে যায়। 
২০১৭ সালে ১৮৫ জন সিপাহি নিয়োগেও ১৩ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ পায় দুদক। সম্প্রতি ঢাকায় দুদকের উপপরিচালক সিরাজুল হক বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই নিয়োগে প্রতিজনের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা আদায় করা হয়।

২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর রেলওয়ের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ ঘটনায় বিপাকে পড়ে পরীক্ষা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। এই নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১০ সালে দায়িত্ব পালন করা সাবেক জিএম ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধেও বেশ কয়েকটি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তিনি ফুয়েল চেকার, টিকিট চেকার, গুডস সহকারীসহ ১৩টি দুর্নীতি মামলার আসামি। এর মধ্যে দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। ১১টি মামলা এখনো চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন। ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনার পর রেলওয়ের জনবল নিয়োগে দুর্নীতির খবর প্রথম ফাঁস হয়।

রেলের নিয়োগে এত দুর্নীতির অভিযোগের পরও রেলপথ মন্ত্রণালয় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত ও প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সিপাহি নিয়োগে সম্প্রতি দুদকের মামলার পরও দুই আসামি পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম ও পশ্চিমাঞ্চলের চিফ আশাবুল ইসলামকে দুটি নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক করে রাখা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ফোন দিতে বলেন। পরে রেল সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীরের মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় সব সময় দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেয়। যুগ যুগ ধরে সেটা হয়ে আসছে। এর কারণ ভাগটা তাঁরাও পান। সরকারের উচিত পিএসসির মাধ্যমে এসব নিয়োগ নিশ্চিত করা।  

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত