Ajker Patrika

কেউ যদি অনুসরণ করে…

সানজিদা সামরিন
কেউ যদি অনুসরণ করে…

সেদিন রাতে মায়ের বাসা থেকে ফিরছি নিজের বাসায়। রাত সোয়া ৯টার মতো বাজে। মায়ের বাসা থেকে আমার বাসা অবধি আসতে রিকশাভাড়া লাগে ৮০ টাকা। দূরত্বটা বোঝানোর জন্য ভাড়ার কথা বললাম। শহরে রাত সোয়া ৯টা খুব বেশি রাত না। হরতাল ছিল বলে বাস কম ছিল। রিকশায় উঠে কানে হেডফোন গুঁজে নিলাম। একটা স্টপেজ পার হতেই বাঁ পাশ দিয়ে একটা সাইকেল চলে গেল। রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পর ওই সাইকেলটাই চলে গেল ডান পাশ দিয়ে। রাস্তায় ইউ টার্নের জায়গাগুলোয় রিকশা একটু ধীরে চলছিল।

এরপর আবার স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে। আমার সামনে আরও কয়েকটা রিকশা। রিকশাগুলোরও অনেক আগে সেই সাইকেল। আমি আশপাশে তাকিয়ে দেখছি, ভ্যানের ওপর রংবেরঙের শীতের কাপড় উঠেছে। শীতের আগের এই সময়টা খুব ভালো লাগে।

রাস্তায় যানজট নেই, হঠাৎ খেয়াল হলো রিকশাটা খুব ধীরে চলছে। রিকশার আগে, পিছে আবার কখনো পাশে পাশে চলছে সেই সাইকেল। এভাবে কয়েকবার সাইকেল আরোহীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমি মাস্ক পরে আছি। ফলে আমার চোখ ছাড়া কারোরই কিছু দেখার কথা না। এবার আমি সজ্ঞানে খেয়াল করতে লাগলাম। সাইকেলটা মাঝে মাঝে অনেকখানি এগিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট কোনো একটা পয়েন্টে গিয়ে স্লো হচ্ছে বা থেমে যাচ্ছে, যখন আমার রিকশা এগিয়ে তার কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে তখন আবার চলা শুরু করছে। এবার সাইকেল আরোহী মানে ছেলেটা পেছন ফিরেও খেয়াল করা শুরু করেছে, আমার রিকশাটা কত দূর এগোল। মানে নজর রাখছে। সামনে একটা ইউলুপ আছে। ইউলুপের নিচ থেকে সামনে আরও খানিকটা পথ অন্ধকার। সাধারণত সেখানে একটা জ্যাম পড়ে, কিন্তু সেদিন ছিল না। রিকশাওয়ালা চাইলে দ্রুত এগোতে পারতেন, এটা আমার ধারণা। কারণ যে গতিতে এর আগে চালিয়েছেন, এখন প্রায় ফাঁকা পথে তার চেয়েও ধীরে চালাচ্ছেন।

ছেলেটাকে যখন সাইকেল চালিয়ে নেমে যাওয়া ইউলুপের কোনায় চলে যেতে দেখলাম, তখন একটু সতর্ক হলাম। প্রথমত, প্রায় অর্ধেক রাস্তারও বেশি সময় ধরে সে নজরে রাখছে রিকশাটা। দ্বিতীয়ত, আমার হাতে ফোন রয়েছে, ব্যাকপ্যাকের দুই হাতলে হাত ঢুকিয়ে কোলের ওপর রেখে বসে আছি। ফলে সে যদি ছিনতাইকারী হয় তাহলে ফোন বা ব্যাগ ধরে টান দিলে আমি রিকশা থেকে পড়ে যেতে পারি। তা ছাড়া রিকশাওয়ালার ভাবগতি আমার জানা নেই, মানে বুঝতে পারছি না। প্রথমে চট করে আমার হাজবেন্ডকে ফোন দিলাম। পরপর পাঁচটা কল, রিসিভ হলো না। এরপর কাছেপিঠেই থাকেন এমন এক বড় বোনকে কল দিলাম। তিনিও ধরলেন না।

আর চেষ্টা না করে ফোনটা ব্যাগে পুরে রাখলাম। ফোন ধরলেও খুব একটা যে সাহায্য করতে পারত কেউ ব্যাপারটা তা নয়, কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে অন্তত কোন স্পটে আছি এটা যেন অন্তত একজন আন্দাজ করতে পারে। ছেলেটা আমার সামনের দু-একটা রিকশার আগেই চলছে। বরাবরের মতো পেছন ফিরে দেখছে আমার রিকশাটা এগোচ্ছে কি না। হাতের বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম নেমে কোথাও দাঁড়ানোর অপশন পাই কি না। দুয়েকটা ফলের দোকান ছাড়া কিছুই নেই। আমার বাড়ি প্রায় কাছে চলে এসেছে। যদি সেই নেমে যাই তাহলে হেঁটে যেতে সময় লাগবে। আবার রিকশায় গেলে বেশি সময়ের ব্যাপার না। এই রিকশা নিয়ে সরাসরি বাসার গেটে নামা যাবে না। যদি ছেলেটা ফলো করে বাসা অবধি পৌঁছে যায়? ২৫ মিনিট ধরে ফলো করেছে, আর বাকি ৫ মিনিট করবে না? করতেও তো পারে? বাড়ির কাছের সুপারশপে ঢুকে যাব? ছেলেটা যদি শপের বাইরে অপেক্ষা করে?

আমার হাজবেন্ড ফোন ধরছেন না, তিনি কখন ফিরবেন জানি না। মূল সড়ক থেকে যেদিকে আমার এলাকার পথ ঢুকে গেছে, সেখানে ইঞ্জিনচালিত রিকশার জটলা। রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘এখানেই রাখুন।’ তিনি এগোতেই লাগলেন। আমি আবার বললাম। তিনি এগোচ্ছেনই। এবার জোরে ধমক দিয়ে বললাম, ‘আপনি কি রিকশা থামাবেন, নাকি থামাবেন না!’ পেছনে ফিরে হাসি দিয়ে বলল, ‘নেমে যাবেন?’ আমার এখনো অবধি ধারণা ফলো করে এগোনো সাইকেল আরোহী রিকশার জটলার মধ্য়ে আমাকে হারিয়ে ফেলেছে।

রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে একটু এগিয়ে একটা ইঞ্জিনচালিত রিকশায় উঠে হুড তুলে বাড়ির দরজায় এসে নামলাম। এবার আসি সাইকেল আরোহীর প্রসঙ্গে। বেঁটে-খাটো শ্যামবর্ণ ছেলেটা কালো প্যান্ট আর একই রঙের টি-শার্ট পরা ছিল। বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। পেশা ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না। তবে এতটা পথ ডান কি বাঁ পাশ দিয়ে এগিয়ে, প্রয়োজনে সাইকেল থামিয়ে রিকশার দূরত্ব কমানোয় বা বারবার পেছন ফিরে খেয়াল রেখে সর্বোচ্চ ব্যাগ বা ফোনটা ধরে টান দিতে পারত। এর বেশি কিছু না হয়তো। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুসরণ করা ছাড়া এর চেয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়তো ঘটত না।

কিন্তু ওই একই রিকশায় করে যদি আমি বাড়ির দরজায় নামতাম বা ছেলেটা যদি বাড়ি পর্যন্ত ফলো করত, তাহলে অন্য কিছুও হতে পারত। আবার না-ও পারত। কিন্তু কেউ যখন অনুসরণ করে, তখন টের পেলে কী করা উচিত এ ধরনের প্রস্তুতি আসলে আমাদের নেই।

আবার পথেঘাটে দুর্ঘটনা ঘটলে এগিয়ে আসার জন্যও মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবা উচিত। পরিচিত কাউকে কাউকে ফোন দিয়ে অন্তত লোকেশনটা বলা প্রয়োজন, ফোনে না পেলেও অন্তত মেসেজ করে রাখা দরকার। আর অনুসরণকারী যেন আপনার গন্তব্য (বাড়ি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) কোনোটা অবধিই পৌঁছাতে না পারে, সেটাও মাথায় রেখে দিক পরিবর্তন করতে হবে।

সানজিদা সামরিন, সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৯ পুলিশ পরিদর্শক বাধ্যতামূলক অবসরে

‎ডিভোর্সের পরও জোর করে রাতযাপন, বর্তমান স্বামীকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে হত্যা ‎

গণবিক্ষোভ আতঙ্কে মোদি সরকার, ১৯৭৪-পরবর্তী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণার নির্দেশ

নিজের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি কলেজশিক্ষকের

আমাদের জন্য ভারত নেই, বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরতে হবে—বিএনপি নেতার সতর্কবার্তা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত