Ajker Patrika

বেনাপোল স্থলবন্দর: জালিয়াতদেরই দৌরাত্ম্য, মিথ্যা ঘোষণার হিড়িক

রাশেদ নিজাম ও আজিজুল হক, বেনাপোল (যশোর) থেকে
বেনাপোল স্থলবন্দর: জালিয়াতদেরই দৌরাত্ম্য, মিথ্যা ঘোষণার হিড়িক

বন্দর দিয়ে বড় এক ট্রাক টমেটো আমদানি করতে শুল্ক লাগে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। একই আকারের ট্রাকে আনার আনতে ২৭ লাখ, আপেল আনতে ২৩ লাখ আর কমলা আনতে শুল্ক লাগে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বড় মাধ্যম হলো এই পচনশীল দ্রব্য। টমেটো ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে আনার, আপেল কিংবা কমলা। শুল্ক ফাঁকির হরেক রকম কৌশল আছে এখানে। এমনকি রাজস্ব না দিয়েও পণ্য খালাস করা হয়। অভিযোগ আছে, কাস্টমস কমিশনারসহ অনেক কর্মকর্তার এতে লাভ।

বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টমস কমিশনার আব্দুল হাকিম কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকারও করেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। তবে নিজের জড়িত থাকার অভিযোগ অসত্য বলে তাঁর দাবি।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বন্দরে শুল্ক ফাঁকিবাজ চক্রের যোগসাজশে কিছু আমদানিকারক কম শুল্কের পণ্য ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কের পণ্য নিয়ে যান। তাঁরা বলেন, দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য, রাজস্ব ফাঁকি জায়েজ করতে অন্যের পণ্যে আগুন লাগানো, দুর্বল অবকাঠামোসহ নানা কারণে টানা পাঁচ বছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ দেশের সবচেয়ে বড় এই স্থলবন্দর। জানা যায়, কিছুদিন আগে রয়েল সিঅ্যান্ডএফ প্রায় ৩৯ ট্রাক পণ্য বন্দর থেকে বের করে নেয় রাজস্ব ছাড়াই। সংবাদ প্রকাশ হলে তারা টাকা শোধ করে।  

নিরাপত্তার কারণে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলতে চান না কোনো সৎ ব্যবসায়ী। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, রয়েল ছাড়াও, সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান রুমা, জারিনা, শান্ত ও শামীম এন্টারপ্রাইজ মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানিসহ নানা অনিয়মে জড়িত। কখনো কখনো ফলের ট্রাকে নিষিদ্ধ ওষুধ, মোবাইল ফোনসেট এনে খালাস করা হয় রাতে। এ ছাড়া ভারত থেকে ৩২ টন আপেল এনে ঘোষণা দেওয়া হয় ২৩ টন, ২৯ টনের গাড়িতে এনে বলা হয় ২৩ টন। আরও কিছু পণ্যে এমন কৌশল নেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে রয়েল এন্টারপ্রাইজের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা এসব বলেছে তারা চোর-ডাকাত। তারাই দুর্নীতি করে।’

বারবার আগুন নিয়ে সন্দেহ  দেশের অন্য স্থলবন্দরের তুলনায় বেনাপোলে আগুন লাগার ঘটনা অনেক বেশি। বছরে ২-৩ বার আগুন লাগে এখানে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়েছেন। কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই। আবার অনেকেই এই আগুনকে দেখেন সন্দেহের চোখে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কিছু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের সঙ্গে কম টাকায় পণ্য খালাসের চুক্তি করে। ১০ ট্রাক পণ্য আনার পর একটির রাজস্ব দিয়ে বাকি ৯টি রাতে বের করে নেয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। তখন ওখানে থাকা বাকি পণ্যে আগুন দিয়ে তাদের সেই ৯ ট্রাকও পুড়ে গেছে বলে দাবি করে।

আমদানিকারক বেলাল হোসেন জানান, তিনি ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বন্দরে পণ্যাগারে আগুনে তার ২২ লাখ টাকার পণ্য পুড়লেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে এখন অন্যের চাকরি করেন। জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল আগুনে পুড়ে পাঁচ ট্রাক পণ্য। ২১ অক্টোবর রাসায়নিক পণ্যাগারে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা রতন কুমার দেবনাথ জানান, ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়। আগুন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করে না। 
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘বন্দরে সুরক্ষা বাড়াতে বিভিন্ন বৈঠকে দাবি তুলেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে বন্দর পরিচালক মো. মনিরুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। উপপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিলের দাবি, সাড়ে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে, নাশকতার সুযোগ নেই।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বন্দরের ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি পণ্য থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। তবে রাজস্ব পূরণ না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেওয়ায় বছরের শেষের দিকে লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। এরপরও ঘাটতি হয় ৫৫৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এর আগের তিন অর্থবছরে ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি, ১ হাজার ১৪৫ কোটি এবং ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশের স্থলবাণিজ্যের ৮০ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়। তবে কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বন্দরের সক্ষমতা বাড়লে বেনাপোল দিয়ে রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ হবে।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়া প্রসঙ্গে কাস্টমস কমিশনার আব্দুল হাকিম বলেন, ‘এটা মূলত বাণিজ্যপ্রবাহ, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির ট্রেন্ডের ওপর নির্ভর করে। এনবিআর থেকে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সে পরিমাণ আমদানি না হলে তো অর্জন হবে না।’ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাজস্ব ঘাটতি কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তিনি। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

শাস্তি পাচ্ছেন বিটিআরসির মহাপরিচালকসহ ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

ভূমি অফিসের কাণ্ড: এসি ল্যান্ড দপ্তরের নামে দেড় কোটি টাকা আদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত