Ajker Patrika

বিবেকের কাছে প্রশ্ন

রহমান মৃধা
বিবেকের কাছে প্রশ্ন

একটি ডিম বাইরে শক্ত, ভেতরে তরল। একটি আলু বাইরে এবং ভেতরে একই অবস্থা সাধারণ পরিবেশে, কিন্তু ফুটন্ত গরম পানিতে ডিম সেদ্ধ হয়ে হয় শক্ত, আর আলু হয় নরম। আবার সেই একই ডিম বাইরের চাপে ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়, অথচ ভেতরের চাপে কোনো এক সময় একটি নতুন জীবনের সৃষ্টি করে! 
পৃথিবী সৃষ্টির পর যুগের হাওয়ায় কত কী ঘটেছে, সেগুলো স্মৃতি হয়ে আছে। তবে কী ঘটতে পারে, জানা নেই।

জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জমা হয়ে যায় আমাদের মস্তিষ্কে। এই মস্তিষ্কে জমা সব ঘটনা স্মৃতি হিসেবে আজীবন আমাদের সঙ্গে থাকে। ঠিক একই সঙ্গে আমরা আমাদের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন চিন্তাভাবনার সন্ধানে লেগে থাকি। কারণ, জীবনের ঘটে যাওয়া ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় যা কিছু করি তার সবই জমা হয়ে রয়েছে মস্তিষ্কে। ফলে কল্পনায় ভালো জিনিসের সঙ্গে আবর্জনাও এসে হাজির হয়।

স্মৃতি এবং কল্পনা মূলত স্রষ্টার তৈরি কম্পিউটার। একটি সুন্দর জীবন পেতে যা কিছু দরকার তার সবকিছুই স্রষ্টা আমাদের দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম আমাদের বিবেক।

আমি ইচ্ছে করে বা চেষ্টা করে বাংলাদেশে জন্ম নিইনি বা সুইডিশ পরিবারে জন্ম নেওয়ার জন্য কোথাও তদবির করিনি। ধর্মীয়ভাবে যদি দেখি, যেমন খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নিলে খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা ও অবদানকে বোধ করতাম এবং তাদের উত্তরসূরি হিসেবে গর্ব করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতাম। বাইবেলের কথাকে নির্ভেজাল সত্য দাবি করে অন্যদের সঙ্গে তর্ক করতাম। খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম না নেওয়ার জন্য কোনো চেষ্টা বা তদবির করার সুযোগও আমার ছিল না। ঠিক একইভাবে যদি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিতাম, তবে আমার বিশ্বাস ও বোধ-বুদ্ধি হিন্দু জীবনধারার সঙ্গে গেঁথে যেত। হিন্দু পরিবারে না জন্মানোর জন্য আমি কারও কাছে তদবির করিনি।

আমার জন্মের পর ঠিক সেই সময়ে মুসলমান পরিবারের নিয়মানুযায়ী আজান দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন জানতাম না, আমি একজন মুসলমান। কিন্তু আমার পরিবার নিশ্চিত জানত, আমি একজন মুসলমান। জন্মের সময় আমি কিছুই জানিনি, অথচ আমার পরিবার জানত আমি মুসলমান। একইভাবে একটি হিন্দু শিশুর জন্মে সেই পরিবারে উলুধ্বনি হয়েছে, শঙ্খধ্বনি হয়েছে।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার মাকে আমি সুর করে কোরআন শরিফ পড়তে দেখেছি, নামাজ পড়তে দেখেছি। অন্যান্য মুসলিম বাচ্চার মতো আমার বাবা আমাকে সঙ্গে করে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি এখন পাক্কা মুসলমান; ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করি এবং ইসলামি বইয়ে যা বলা আছে তা-ই সত্য বলে বিশ্বাস করি। একইভাবে যে ছেলেটি হিন্দু ঘরে জন্মেছে, সে-ও তার মাকে সুর করে রামায়ণ-মহাভারত পড়তে দেখেছে, তুলসীতলায় বাতি দিতে দেখেছে। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নেওয়ায় মক্কা-মদিনাকে তীর্থ ভাবি। অন্যজন হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়ে গয়া, কাশী, বৃন্দাবনকে তীর্থস্থান ভাবে। আমাদের কেউ চেষ্টা করে বা তদবির করে হিন্দু বা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিতে চেষ্টা করিনি।

আদিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুটির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আফ্রিকার জুলু ধর্মের অনুসারীদের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসগুলো একই প্রক্রিয়ায় তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে।

পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ধর্ম এবং তার চেয়েও শত সহস্র বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক সব মানুষের জন্ম এবং বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনে বিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়েছে। এখন যদি নিজের জীবনের মধ্যে আরোপিত বিশ্বাসকে সত্য এবং বাকিদের সবাই ভুল বা অসত্য মনে করি, তবে কী মনে হয়? আমাদের বিবেক কী বলে?

খুব কমসংখ্যক মানুষ পড়াশোনা করে বা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে তার আজন্মলালিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে। তারপরও আমরা কেন যেন সত্যিকারের মানুষ হতে পারিনি। সবকিছু জেনেশুনেও কি মানুষের মাঝে মানবতা নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়? বিবেক যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তাহলে সব মন্দ-মিথ্যা-অন্যায়কে মস্তিষ্কের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব।

সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত