Ajker Patrika

শক্তিশালী ভূমিকম্প ছাড়া সুনামি হবে কী করে

অরুণ কর্মকার
শক্তিশালী ভূমিকম্প ছাড়া সুনামি হবে কী করে

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে সুনামির মতো একটি সর্বপ্লাবি গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন। গত বুধবার এক সভায় তিনি তাঁর এই উপলব্ধির কথা প্রকাশ করে প্রকারান্তরে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এমন একটি জাগরণ সৃষ্টির।

মির্জা ফখরুল ইসলাম নিশ্চয়ই জানেন যে সুনামি সৃষ্টি হয় ভূমিকম্পের প্রভাবে। তা-ও যেমন-তেমন ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে না। সাগর-মহাসাগরের বিপুল জলরাশিকে উত্তাল করে প্লাবন সৃষ্টি করার জন্য মাঝারি ভূমিকম্পও যথেষ্ট নয়। বেশ বড় আকারের ভূমিকম্পই পারে তেমন প্লাবন সৃষ্টি করতে। সে জন্যই সুনামি খুব কমই হয়। তবে যখন হয় তখন, সে শুধু ধ্বংসই করে না, সব জঞ্জাল ডুবিয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে প্লাবনভূমিকে সাফ-সুতরো করে ফেলে।

সুনামির মতো একটি গণজাগরণের যে প্রয়োজনীয়তা মির্জা ফখরুল উপলব্ধি করেছেন এবং বলেছেন, তা বোধ হয় উপেক্ষা করার নয়। কারণ আমাদের সমাজে এতশত জঞ্জালের স্তূপ জমা হয়েছে এবং পূতিগন্ধ ছড়াচ্ছে যে সুস্থ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের আর্থিক খাত থেকে দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার দুর্গন্ধ ক্রমাগতভাবে বেশি বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে আরও আগে, যখন জনগণকে উপেক্ষা করে রাজনীতিকে অর্থ ও অস্ত্রের কাছে সমর্পণ করার ধারা শুরু হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতি মানুষের মনোজগতে আলোড়ন তোলা এবং পরিবর্তন সাধনের উপযোগিতা হারিয়েছে। সমাজে শ্রেণিবিভেদ প্রকট হয়েছে। অর্থ-বিত্ত, পেশি ও অবৈধ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট প্রভাব এই বিভেদকে প্রতিনিয়ত প্রকটতর করছে।

সমাজের উপরিস্তরে সৃষ্ট এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটছে মানুষের নৈমিত্তিক জীবনে। এর সর্বজনগ্রাহ্য একটি উদাহরণ হতে পারে দ্রব্যমূল্য। কতকটা বাস্তবতা এবং বেশির ভাগই কারসাজির কারণে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে বেশি, এ বিষয়ে বোধ হয় কারোরই দ্বিমত নেই। কিন্তু পাশাপাশি বাজারে কোনো জিনিস অবিক্রীত থাকার নজিরও খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং প্রতিযোগিতা করেই কেনা-বেচা চলে। আরেক বাস্তবতা হলো এই অবস্থা সত্ত্বেও সমাজে ও রাষ্ট্রে একধরনের স্থিতিশীলতা বজায় অছে। এ এক অদ্ভুত অবস্থা।

প্রশ্ন হলো এই জাগরণ সৃষ্টি করবে কে? এটিই এখন আমাদের সামনে ‘মিলিয়ন ডলারের কোয়েশ্চেন’। কারণ সুনামি সৃষ্টির জন্য যে শক্তিশালী ভূমিকম্প দরকার তার কোনো হদিস নেই। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়তো এই ভূমিকম্প সৃষ্টির ব্যাপারে প্রত্যয়ী ছিলেন, যখন এক দফা ঘোষণা করেছিলেন। সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সেই এক দফার আন্দোলন একটা সৃনামি সৃষ্টিকারী ভূমিকম্প সংঘটিত করতে পারবে বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। এখনো যে সে বিশ্বাস নেই তা বলছি না।

এখনো হয়তো আছে। তবে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে তার কোনো প্রতিফলন নেই; বরং এক দফার আন্দোলনকে কিছুটা বিভ্রান্ত পথিকের মতো মনে হচ্ছে, যিনি পথের কথা জানেন কিন্তু পাথেয় জানেন না।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমি গণমাধ্যমে সব সময়ই দেখি। তাঁর বক্তব্য শুনি। গত বুধবারও শুনেছি যখন তিনি সুনামির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন। আমার কাছে ওই দিন তাঁকে কিছুটা অস্থির মনে হয়েছে। এর দুটি কারণ হতে পারে। এক. নিজের শারীরিক অবস্থা। ওই বক্তব্য দেওয়ার পরদিনই তিনি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। তার মানে তিনি কিছুটা অসুস্থই ছিলেন, যা হয়তো তাঁর মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকবে। দুই. বড় মুখ করে এক দফার আন্দোলনের পথে নেমেও পাথেয় খুঁজে না পাওয়া।  

তাঁর অস্থিরতার কারণ হিসেবে এর কোনোটিকেই উপেক্ষা করা যায় না। তবে প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয় কারণটি তাঁর কাছে অনেক বেশি অস্বস্তির হতে পারে। কেননা এক দফার আন্দোলন এখন পর্যন্ত বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারেনি। খুব শিগগির যে তা পারবে, তারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্তত বিএনপি এবং তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে আন্দোলনে শিগগিরই এমন কোনো গতি সঞ্চার করতে সমর্থ হবে, সে লক্ষণ নেই। এ বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন পর্বের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এবং এগিয়ে চলা আন্দোলনে কর্মী-সমর্থকদের যে সম্পৃক্তি লক্ষ করা গিয়েছিল, পাথেয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার অভাবে তাতেও যেন কিছুটা ভাটার টান পড়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের আরেকটি প্রেরণা ছিল বিদেশি শক্তির ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ তুলে বিএনপি এবং সমমনাদের আন্দোলনে পরোক্ষভাবে যে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছিল তা-ও এখন যথেষ্ট ম্রিয়মাণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা ও বিভিন্ন সহযোগী শক্তির অবস্থানদৃষ্টে তাদের অবস্থানও পরিবর্তন হতেই পারে। তারা এখন এমনটাও ভাবতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন যে সরকার দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে মৌলবাদী জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্ন তুলে সেই সরকারকে বিচলিত করা ভবিষ্যতের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে?

বিএনপি ও তার সমমনাদের আন্দোলনের পাশাপাশি শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা এবং কিছু কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার যে গুজব চাউর হয়েছিল তারও একটি বিপরীত ফল ফলেছে বলে মনে হয়। ওই ভিসা নীতি এবং স্যাংশন বিষয়ে জল্পনা নিশ্চয়ই আন্দোলনকে সহায়তার জন্য করা হয়নি। কিন্তু যে সময় সেগুলো করা হয়েছে, তাতে সেগুলো আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার জন্য করা হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওই উদ্যোগগুলো যাদের চাপে ফেলেছিল, তারা সেই চাপ সামলানোর জন্য ভিন্ন কূটনীতি চেলেছে। সেই কূটনীতির লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে এ কথা বুঝিয়ে দেওয়া যে চাপ সামলানোর জন্য তাদের ভিন্ন শক্তির সহায়তা নেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রই তাদের বাধ্য করছে সেই পথে যেতে, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থানুকূল হবে না।

এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা কূটনৈতিক চাপও সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই সামনে আনা হয়েছে পাকিস্তান প্রসঙ্গ। পাকিস্তানের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। সেই পাকিস্তানের ব্যাপারে তো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আলাদা নীতি কিংবা স্যাংশন আরোপের কথা শোনা যায় না! তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারিত হয়! ভারতের প্রসঙ্গও এ ক্ষেত্রে অনুল্লেখযোগ্য নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপরও তো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু সেই মোদিকেও তো যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে এটা করেছে, ভারত ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখা, সেখানেও তো বাংলাদেশ সম্পৃক্ত আছে। তা সে সম্পৃক্তি যত ছোটই হোক। 

সর্বোপরি মিয়ামনমারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও নিষেধাজ্ঞার ফলাফল কী? কোনো সুফল আছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য? ওই নীতি তো মিয়ানমারকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরও হোস্টাইল করেছে। তাতে কি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের উপযোগী কিছু অর্জিত হয়েছে? একই রকম নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে সুফল পাওয়ারও কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? এখানেও কি যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে না? এসব প্রশ্ন উঠেছে। আলোচিত হচ্ছে।

তাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রত্যাশিত সুনামির দেখা মেলার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হয়ে পড়ছে। তবে নিজেদের শক্তিতে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারলে অন্য সব পারিপার্শ্বিকতাও বদলে যেতে পারে। সুনামি সৃষ্টির আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: বাকের মজুমদার

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

চাকরিতে কোটা: সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য আসছে সমান সুযোগ

রাজপথের চাপে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়: চিফ প্রসিকিউটর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত