Ajker Patrika

ব্রহ্মপুত্রে বিলীন আদিবাসীদের স্বপ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২২, ১৩: ০১
ব্রহ্মপুত্রে বিলীন আদিবাসীদের স্বপ্ন

প্রতিবছর ভারী বৃষ্টি থেকে সৃষ্ট বন্যায় তলিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষা উত্তর-পূর্ব ভারতের বেসেমোরা গ্রাম। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় ঘরবাড়ি। গত এক দশকে আটবার নিজের ঘর পুনর্নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছেন এই গ্রামের বাসিন্দা হেমরাম পেগু।
তাঁর মতো অনেকেই ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদীর তীরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন, যাঁরা আদিবাসী ‘মিসিং’ জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।আসামের বড়-কাছাড়িদের পরেই জনজাতিসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনজাতি—মিসিং। তাঁরা সাধারণত নদীর পাড়ে চাংঘর তৈরি করে বাস করেন। কিন্তু জলবায়ুর অপ্রত্যাশিত চেহারায় দায়টি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
আসাম রাজ্যের নদীমাতৃক দ্বীপ মাজুলিতে থাকা নিজের ঘরের কথা উল্লেখ করে ৫২ বছর বয়সী পেগু বলেন, ‘আমাদের গ্রামের আসল মানচিত্র এখন ইতিহাস। প্রতিবার বন্যার সময় আমাদের গ্রামের ২০০ থেকে ৩০০ মিটার ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যায়। আর প্রতিবারই আমরা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে থাকি।’

কাজের সংকট এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর উচ্চনির্ভরতার কারণে সারা বিশ্বের অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো মিসিংরাও প্রায়ই চরম আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই ‘সাধারণ বিষয়’ হয়ে উঠছে। বর্ষা মৌসুমে ফুঁসে ওঠা ব্রহ্মপুত্র বেসেমোরা গ্রামের পরিবারগুলোকে স্থানচ্যুত করার পাশাপাশি চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের জীবিকার ওপরও।

জলবায়ু পরিবর্তন বা উষ্ণায়নকে তীব্র বন্যার একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বিজ্ঞানী পার্থ জ্যোতি দাস জানান, আসামে গত দশকে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার ধরনে ‘উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি’ সৃষ্টি হয়েছে। গুয়াহাটিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আরণ্যকের পানি, জলবায়ু ও ঝুঁকিবিষয়ক বিভাগের প্রধান পার্থ বলেন, ‘আগে প্রত্যাশিত সময়ে অনুমানযোগ্য পরিমাণে বৃষ্টি হতো। কিন্তু এখন আমরা নিয়মিত এবং অসময়ে ভারী বর্ষণ দেখতে পাচ্ছি, যা আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করে।’

২০১৮ সালে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতীয় হিমালয় রাজ্যগুলোর মধ্যে ধ্বংসাত্মক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজ্য আসাম। এই ঝুঁকির পেছনে আসামের নিম্ন মাথাপিছু আয়, শস্যবিমার হার, সেচের অধীনে থাকা জমিসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সমীক্ষায়। জমির কথা উল্লেখ করার বড় কারণ, রাজ্যটির কৃষকদের জমিতে পানি দেওয়ার জন্য নিয়মিত বৃষ্টিপাতের ওপরই নির্ভর করতে হয়।

রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আসামে ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বন্যায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৬০ জনের।

বেসেমোরা গ্রামের পেগু জানান, বন্যার ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে সেখানকার বাসিন্দারা প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র নদের পানির স্তরের ওপর নির্ভর করে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশের ঘরের মেঝে উঁচু করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বন্যার পানির তোড়ে অনেক সময় তাঁদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তলিয়ে যায় পুরো গ্রাম, নদীতে বিলীন হয় অনেক ঘরবাড়ি।

বেসেমোরা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে সালমোরা গ্রামের বিনুদ দোলি নামে এক বাসিন্দা জানালেন ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো আরও একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর তা হলো, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নিজেদের জমি পুনরুদ্ধার করা। কারণ, ঐতিহ্যগতভাবেই নদীতীরের অব্যবহৃত জমিতে বসতি স্থাপন করে আসছে মিসিংরা। আর এই জমির মালিকানা প্রমাণ করার জন্য কোনো দলিল নেই তাদের কাছে।

এ ছাড়া বন্যা ও নদীভাঙনের প্রভাব, কৃষিকাজের বিস্তার এবং এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ফলে বাস করার জন্য সহজলভ্য জমিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে বলে জানান বিনুদ দোলি।

দীর্ঘমেয়াদি সমাধান

বোঙ্গাইগাঁও নামে স্থানীয় এক গ্রামের পঞ্চায়েত সভাপতি সিসুরাম ভারালি জানালেন, এই অঞ্চলে প্রবল বন্যার পরে গ্রামবাসীর পুনর্বাসনে সাহায্য করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার। এ ছাড়া রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি বন্যাপ্রবণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে আসাম সরকার। তবে বন্যা ও এর ক্ষয়জনিত সমস্যা কমিয়ে আনতে এখনো কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুর্যোগ ও অভিবাসনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক তুহিন কে দাস জানান, ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়কে (জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ) জলবায়ু-প্ররোচিত বাস্তুচ্যুতি থেকে রক্ষা করতে, তাদের পুনর্বাসন, শিক্ষা, জীবিকা পুনরুদ্ধার এবং চাকরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সরকারের উচিত নীতি তৈরি করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত