Ajker Patrika

ভাবমূর্তি ফেরাতে কী করতে পারে নির্বাচন কমিশন

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২২, ১২: ২২
ভাবমূর্তি ফেরাতে কী করতে পারে নির্বাচন কমিশন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে ৬ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনের একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন ২৬ ফেব্রুয়ারি শপথ গ্রহণ করে পরদিনই অফিসে গিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। এরপর কমিশন ধারাবাহিকভাবে সংলাপ বা মতবিনিময় শুরু করেছে। ১৩ মার্চ প্রথম দফায় শিক্ষাবিদদের সঙ্গে, ২২ মার্চ দ্বিতীয় দফায় বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে এবং তৃতীয় দফায় ৬ এপ্রিল জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় হয়। তৃতীয় দফার মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের কয়েকজন উপস্থিত হয়ে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এসব মতামত বা পরামর্শ শুনে নির্বাচন কমিশন কতটুকু উপকৃত হবে বা এর থেকে কতটুকু তারা গ্রহণ করবে, তা আমি জানি না। তবে সবার কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমি উপকৃত হয়েছি।

অতিথিদের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছে: ‘জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনে ভোটাররা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন। তাঁরা স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চান। নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে অবাধ অনুষ্ঠানের জন্য যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। এর পরই চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যা সময়ের সঙ্গে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনসহ (ইভিএম) বিভিন্ন আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন পরিচালনায় রয়েছে প্রশিক্ষিত জনবল।’

চিঠির এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটারদের প্রত্যাশা কী এবং কমিশনেরইবা করণীয় কী। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যুগোপযোগী আইন, বিধিমালা, প্রশিক্ষিত জনবল—সবই আছে কমিশনের কাছে। তাহলে কেন ধারাবাহিক সংলাপ? এই প্রশ্নের উত্তরও চিঠিতে আছে। বলা হয়েছে: ‘নির্বাচন কমিশন বিশ্বাস করে, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, পর্যবেক্ষক, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সবার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

‘সংশ্লিষ্ট সবার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে’ বলে নির্বাচন কমিশন ‘বিশ্বাস’ করলেও সম্পাদক-সিনিয়র সাংবাদিকেরা ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ করার জন্য যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, তার সবগুলোই আমার কাছে অন্তত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মনে হয়নি এবং কিছু মতামত ‘সুচিন্তিত’ বলেও মনে হয়নি। হতে পারে এটা আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না—এমন কিছু করার পরামর্শও কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। যেমন বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার কথা কেউ কেউ বলেছেন। এটা ঠিক যে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না, তেমনি এটাও তো ঠিক যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কী? সরকারকে পদত্যাগ করে ‘নির্বাচনকালীন’ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধ্য করবে নির্বাচন কমিশন? নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দিয়ে বাহ্বা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটা তারা করতে পারবে না। ওটা তাদের কাজ নয়।

দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পালনের প্রত্যাশা করা একেবারেই যুক্তিহীন। সব দলের অংশগ্রহণ যেমন ভালো নির্বাচনের একটি অন্যতম উপাদান, তেমনি এটাও ঠিক যে সব দলের নির্বাচনে আসা ও না আসার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। এটা রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত ও কৌশলের বিষয়।

নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর মানুষের আস্থার যে চরম সংকট রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। আবার এটাও ঠিক যে নতুন নির্বাচন কমিশনের হাতে এমন কোনো অলৌকিক সুইচ নেই, যেটা টিপে দিলেই কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার বাল্ব মুহূর্তেই জ্বলে উঠবে। দু-একজন বলছেন, মানুষের আস্থা ফেরাতে বর্তমান কমিশনকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। কী হবে সেই ‘সাহসী’ পদক্ষেপ? প্রথমত, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা যেন বাধাগ্রস্ত কিংবা ব্যাহত না হয়। সবল পক্ষ যেন তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থীর ওপর চড়াও হতে না পারে। কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীর সভা-সমাবেশে হামলা করলে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা কিংবা নিষ্ক্রিয়তা দেখানো না হয়। দ্বিতীয়ত, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নির্বিঘ্নে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে নিজের বাসাবাড়িতে ফিরতে পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করবে নির্বাচন কমিশন। তবে এ ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার সম্মিলন ঘটতে হবে।

আইন ও বিধিতেই এটা আছে যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তখন প্রশাসনের কোনো ছোটবড় কর্মকর্তা—হোন তিনি ডিসি, এসপি কিংবা ইউএনও বা থানার ওসি—কেউ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্য করতে পারবেন না। করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে এই কাজ সাহস ও দৃঢ়তা সঙ্গে করতে হবে। কোনো পক্ষই যাতে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেদিকে কমিশনকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। রাজনৈতিক, পেশি ও অর্থশক্তি ছাড়াও আজকাল ধর্মীয় অপপ্রচার নির্বাচনকে তথা ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র এই অপশক্তিগুলোর ভূমিকা সব সময় নেতিবাচক। এই অপশক্তিগুলোর অপতৎপরতার প্রতি নির্বাচন কমিশনের নজরদারি থাকতে হবে। অতীতে কোনো নির্বাচন কমিশনই এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সৎসাহস দেখাতে পারেনি। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নতুন কমিশন সেখানে পরিবর্তন দেখাতে পারলেই মানুষের আস্থা ফিরবে।

জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির নিজস্ব জনবল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ কেউ কেউ দিয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, ইসির জনবল দিয়ে নির্বাচনী কাজ করা হলে নির্বাচনে সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ অনেক কমে যাবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গেও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ আছে। সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া কি ভিন্ন? জেলা প্রশাসক যদি সরকারের হুকুমবরদার হয়ে থাকেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা কার অনুগত?

একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০০৫ সালে উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬২ জন নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল হাওয়া ভবনের তালিকা অনুযায়ী। তারেক রহমানের অনুগত ক্যাডারদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে পরে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে একবার নিয়োগ পেলে সেটা বাতিল করার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘ। তবে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ৮২ জনের নিয়োগ বাতিল করার পর তাঁরা আদালতে গিয়েছেন। এখনো সেটা সম্ভবত আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। ওই সময় নিয়োগপ্রাপ্তরা পদোন্নতি পেয়ে এখন নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় দায়িত্বে আছেন। তারেক রহমানের ওই সব ক্যাডারকে দায়িত্ব দিলে তাঁরা জেলা প্রশাসকদের চেয়ে পক্ষপাতমুক্ত ভূমিকা পালন করবেন বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। যাঁরা নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোকবল দিয়ে নির্বাচন পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁরা জেনেবুঝে এই পরামর্শ দিয়েছেন, নাকি কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। শ ম জাকারিয়া ও জকরিয়া নামে নির্বাচন কমিশনের দুজন কর্মকর্তার কথা মনে পড়ে, যাঁরা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি থেকে এমন অনেক কিছু করেছিলেন, যা নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল। এটাও মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় মানেই প্রশাসনে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী রাজনীতির দর্শনে বিশ্বাসী নন। ভোল পাল্টানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করে ঢালাও দোষারোপ করা ভালো নয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে এসে আমরা যদি একটি বিতর্কমুক্ত ভালো নির্বাচন করতে না পারি, তাহলে তা আমাদের, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যই লজ্জার। এই লজ্জাবোধ যদি সবার মধ্যে না আসে, তাহলে নির্বাচন কমিশন একা কী করবে? তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার কমিশনার প্রত্যেকে নিজেদের চাকরিজীবন শেষ করে এসেছেন। নির্বাচন কমিশনার পদগুলো হচ্ছে তাঁদের জন্য বোনাস। কাজেই তাঁদের হারানোর কিছু নেই। মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ আছে। সংবিধান, আইন, বিধিমালা অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে হেঁটে সেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জনের সম্ভাবনা তাঁদের সামনে আছে।

নির্বাচন কমিশন বা ইসি নিয়ে যে ‘ছি ছি’ ভাব, তা কাটিয়ে উঠে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কুমিল্লা দিয়েই কমিশন শুরু করতে পারে আস্থা ফেরানোর প্রক্রিয়া। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় বা কোনো উপনির্বাচন যদি হয়, তাহলে সেগুলোতেই হবে তাদের যোগ্যতার পরীক্ষা। অনেক কিছু করার পরিকল্পনা না করে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কাজ করলেই মানুষ কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সঙ্গে থাকতে রাজি হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত