Ajker Patrika

যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই বিব্রত

রাহুল শর্মা ও শরীফুল ইসলাম ইন্না, সিরাজগঞ্জ থেকে
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪: ০৭
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই বিব্রত

মহিলা কলেজে ছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্ররাও কেন ঢুকছে? বাইরে থেকে কেউ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গেলে এ প্রশ্ন জাগবেই। কারণ শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে পাঠদান চলে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ছাত্রছাত্রীদের আলাদা পাঠদানের নিয়ম নেই। সরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

গত বুধবার শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের সামনে গিয়ে প্রধান ফটক ও লাগোয়া আরেকটি ‘পকেট’ ফটক দিয়ে ছেলেমেয়েদের ঢুকতে-বেরোতে দেখা যায়। সবার কাঁধে ব্যাগ। কারও কারও হাতে বই-খাতা। মহিলা কলেজে ছেলেরা কেন ঢুকছে জানতে চাইলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বলেন, ‘ছাওয়াল হইওয়াও আমাগোরে পড়া লাগে মহিলা কলেজে। এডো যে কী লজ্জার, তা কেবা কইরা কই!’ ওই শিক্ষার্থী নিজের নাম-পরিচয় জানাতে রাজি হননি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্রূপ
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. সোহাগ হোসেন বলেন, ‘আমরা যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, এ কথা কাউকে বলতে পারি না, লজ্জা লাগে।সবাই বলে আমরা তো মহিলা কলেজে পড়ি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মহিলা কলেজে ক্লাস চলায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছি। এ জন্য এখন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ি– এ কথা কাউকে বলি না।’

সংগীত বিভাগের আব্দুল মোন্নাফ হোসেন বলেন, ‘আমার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে। নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বাদই পেলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?’

শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নামেই সরকারি। এখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্যতম সুযোগ-সুবিধাও নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, ‘সবাই বলে আমরা মহিলা কলেজের শিক্ষক।’

শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে যাওয়ার আগে দাড়িয়াপুর বাজার ফলপট্টিতে কথা হয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে আসার কথা জানালে তাঁর উল্টো প্রশ্ন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ক্যাম্পাসে যাবেন?’ দুই দিন অবস্থান করে জানা যায়, শাহজাদপুরে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান চলে শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও মাওলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসের কিছু অংশে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। এর বাইরে দুটি ভাড়া করা ভবনে চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম।

আইন পাস ২০১৬ সালে 
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে ২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল পাঠদান কার্যক্রম শুরু করার মধ্য দিয়ে যাত্রা হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের। বর্তমানে পাঁচটি বিভাগে ৫৫০ শিক্ষার্থী, ২৫ জন শিক্ষক এবং ১৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ২০১৫ সালের ৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দেশের ৩৫তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ আইন পাস হয় জাতীয় সংসদে।

জানা যায়, শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে পাঠদান হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিভাগের। এগুলো হলো—সংগীত, বাংলা, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান। মাওলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া ডিগ্রি কলেজে হয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের ক্লাস।  

দুর্ভোগের শেষ নেই 
সাধারণত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচটি অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। একেকটির দূরত্ব দেড় থেকে দুই কিলোমিটার। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই। বাংলা বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ধন্যজয় হালদার বলেন, কোনো কাজে একটি ক্যাম্পাসে যেতে চাইলে ১০-১৫ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। লাইব্রেরি আরেক ক্যাম্পাসে হওয়ায় অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয় না।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র মো. সাব্বির হোসেন বলেন, ‘এটাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বললেও ভুল হবে। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তো ছাগল চরে না।আমাদের এখানে মাঠে ছাগলও চরানো হয়।’

মাওলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া ডিগ্রি কলেজের মাঠে গিয়ে তেমন দৃশ্যই দেখা গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘এখানে আমরা ভাড়াটিয়া।আমাদের কিছু বলার নেই।’

স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের অসুবিধায় পড়ার কথা স্বীকার করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্থায়ী ক্যাম্পাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টি নানাভাবে অবহেলিত ছিল।দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছরে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি।’

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো অবকাঠামো নেই। শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান (ডানে)। বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজের ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার।চূড়ান্ত হয়নি মহাপরিকল্পনা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ছয় বছরেও মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) চূড়ান্ত হয়নি। একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ চার বছর দায়িত্ব পালনকালে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেননি। শুধু নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার বিশ্বজিৎ ঘোষকে ফোন করে এবং এসএমএস দিয়েও সাড়া মেলেনি।

স্থায়ী ক্যাম্পাস সম্পর্কে জানতে চাইলে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. শাহ্ আজম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র এক বছর আগে। এরই মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে জমা দেওয়া হবে।’

দুই নদীর মোহনায় হবে স্থায়ী ক্যাম্পাস 
কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে শাহজাদপুরের পোতাজিয়া ইউনিয়নের নদীপাড়ে। বড়াল ও গোয়ালা নদীর মোহনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির ২৩৬ একর জায়গায় হবে স্থায়ী ক্যাম্পাস।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই উপাচার্যরা হুটহাট করেই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে দেন। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা হয়েছে, যা দুঃখজনক।’

তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শনিবার (আজ) রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবে এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় ‘জুতার মালা’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মোদির সঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্টের ফোনালাপ

অনেক দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত, দাবি পুতিনের শীর্ষ সহযোগীর

মার্কিন হামলার পর ইসরায়েলে ‘খোররামশহর-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত